স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনব
এনআরবি ব্যাংক পিএলসির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ পুনরায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি আমাদের সময়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ব্যাংকটির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন।
প্রশ্ন : এনআরবি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পেছনে আপনার মূল লক্ষ্য কী ছিল?
ইকবাল আহমেদ : ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার মূল স্বপ্ন ছিল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অনাবাসী বাংলাদেশি (এনআরবি) এবং স্থানীয় অর্থনীতির মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করা। উদ্দেশ্য ছিল রেমিট্যান্স এবং উৎপাদনশীল খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা। একই সঙ্গে প্রবাসীদের পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনের মাধ্যমে যেকোনো মুদ্রায় (ইউএস ডলার, পাউন্ড, ইউরো) অ্যাকাউন্ট খোলাসহ রেমিট্যান্স পঠাতে উৎসাহিত করা। এ ছাড়া দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখা। মুলত, আমরা এমন একটি গতিশীল ও গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠান করতে চেয়েছিলাম; যেখানে স্বচ্ছতা, উদ্ভাবন এবং আস্থার ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হবে। আর এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটির মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অনাবাসীরা বিনিয়োগ ও অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন।
প্রশ্ন : আপনি ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম চেয়ারম্যান। পরবর্তিতে কেনো নিজেকে সরিয়ে নিলেন?
ইকবাল আহমেদ : প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু ২০১৬ সালে নতুন নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে দায়িত্ব ছেড়ে দিই। ওই সময় আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে, একটি শক্তিশালী কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হতে ব্যাংকটি যথেষ্ট পরিপক্ক হয়েছে। তবে ব্যাংকটির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের প্রতি আমার প্রতিশ্রুতি সব সময়ই ছিল।
প্রশ্ন : ৯ বছর পর বাংলাদেশ ব্যাংক আপনাকে আবার এ দায়িত্ব দিয়েছে- এ বিষয়ে অভিব্যক্তি কী?
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
ইকবাল আহমেদ : আমার প্রতি যে আস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক রেখেছে, তাতে সম্মানিত ও কৃতজ্ঞ। এই ফেরাকে আমি গ্রাহক সেবার একটি সুযোগ হিসেবে নিতে চাইছি। সুশাসনকে গুরুত্ব দিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংকটি পরিচালনা করলে সেবার গুণগত পরিবর্তন হবে এবং আমানতকারীদের আস্থা ফিরবে। পাশাপাশি ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ফিরিয়ে আনতে চাই। এ ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করে একটি টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়েও আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রশ্ন : যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, পূর্ববর্তী পর্ষদ কী সেটা ধরে রাখতে পেরেছে?
ইকবাল আহমেদ : সত্যিকার অর্থে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করেছিল পরে সেটি সম্পূর্ণরূপে ধরে রাখা যায়নি। করপোরেট সুশাসন, পরিচালনা এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি ছিল। এই পরিস্থিতি আমাদের একটি সুযোগ দিয়েছে সত্যিকার অর্থে বর্তমান অবস্থা নিরূপণ এবং সম্ভাবনা যাচাই করে পুরনো লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে। এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন : ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকের মধ্যে এনআরবি পিছিয়েÑ এর কারণ কী?
ইকবাল আহমেদ : এর বেশ কতগুলো কারণ রয়েছে। নেতৃত্বের ছন্দপতন একটা বড় কারণ। এ ছাড়া কৌশলগত ধারাবাহিকতার অভাব, দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং আমাদের মূল গ্রাহক ভিত্তি এবং পরিষেবা কাঠামোর বিচ্যুতি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ ও অপারেশনাল দক্ষতায় ঘাটতি সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাসের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমরা এখন জরুরিভাবে এগুলো কাটিয়ে উঠতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
প্রশ্ন : ব্যাংকটির উন্নয়নে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ইকবাল আহমেদ : ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে করপোরেট গভর্ন্যান্সকে শক্তিশালী করা, ডিজিটাল অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ, গ্রাহক পরিষেবার উন্নতি এবং বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়কে পুনরায় সম্পৃক্ত করা। একই সঙ্গে ব্যবসাকে প্রসারিত করতে আমরা ব্যাংকিং সেবাকেও বিস্তৃত করতে পরিকল্পনা নিয়েছি। এর মধ্যে এসএমই খাতে অর্থায়ন, গ্রিন ব্যাংকিং এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং নিশ্চিত করতে চাই। কৃষকের জন্য উপযোগী কৃষি ঋণ ও সঞ্চয় পরিকল্পনা, মহিলাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা, স্বচ্ছতার সঙ্গে ইসলামিক ব্যাংকিং সম্প্রসারণের জন্য শরিয়াহ-সম্মত পরিষেবা, আকর্ষণীয় সঞ্চয় অ্যাকাউন্টসহ যুব ব্যাংকিং, শিক্ষা ঋণ এবং ইন্টার্নশিপের ওপরও জোর দিচ্ছি। এ ছাড়া নৃত্য-নতুন উদ্ভাবন, প্রতিভা বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতের বিষয়টিও নতুন রূপান্তরের এজেন্ডায় থাকবে।
প্রশ্ন : গ্রাহক, বিনিয়োগকারী, শেয়ার হোল্ডার ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের আস্থা ফেরাতে কী কী পদক্ষেপ নেবেন?
ইকবাল আহমেদ : বিগত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে যেভাবে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাতে সবার আস্থা ফেরাতে প্রথমেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কর্মদক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেব। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে কাজ শুরু করেছি। এ ছাড়া অডিট কার্যক্রম শুরু করা, কমপ্লায়েন্স ফ্রেমওয়ার্কগুলোকে পুনর্গঠন এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। পাশাপাশি কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রাণিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গ্রাহক সেবার চার্টার সংশোধন এবং ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন মূল্যবোধের সঙ্গে করপোরেট সংস্কৃতিকে পুনরায় সংযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে উদাহরণ তৈরি করে নেতৃত্বে দেওয়ার মাধ্যমে দৃশ্যমান পরিবর্তন আমরা ঘটাতে চাই।
প্রশ্ন: ব্যাংকটিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সার্বিক উন্নয়নে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন?
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
ইকবাল আহমেদ : পরিবর্তনকে স্বাগত না জানানোর মানসিকতা বদল এবং মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে প্রতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও কমপ্লায়েন্স প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে প্রধান চ্যালেঞ্জ। ঐতিহ্যগত বিষয়টিও দ্রুত ফয়সালা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সবপক্ষের সদিচ্ছা এই সাহস দিচ্ছে যে, আমরা এসব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা জয় করব। এর মাধ্যমেই ব্যাংকটি টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে যাবে।