বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের দুরবস্থা, ফিলিস্তিন সংকটে উত্তরণের পথ

মো. আসিফ হাসান রাজু
০৭ এপ্রিল ২০২৫, ২০:৫৫
শেয়ার :
বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের দুরবস্থা, ফিলিস্তিন সংকটে উত্তরণের পথ

একসময় মুসলিম জাতি ছিল বিশ্বসভ্যতার আলোকবর্তিকা—জ্ঞান, নেতৃত্ব ও ন্যায়ের প্রতীক। কিন্তু আজ মুসলিম বিশ্ব নিপতিত দুরবস্থা, বিভ্রান্তি ও নির্যাতনের গহ্বরে। এ করুণ অবস্থার জন্য যেমন মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা দায়ী, তেমনি দায়ী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও বৈরিতা।

নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এই সংকটের গভীর স্তরগুলো উন্মোচিত হয়। যেমন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, কাঠামোগত সহিংসতা এবং গোষ্ঠীগত সংহতির অভাব। গ্রামশির 'Cultural Hegemony' ধারণা আমাদের দেখায়, কীভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম মুসলিমদের আত্মপরিচয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। অপর দিকে, ইবন খালদুনের ‘আসাবিয়াহ’ বা গোষ্ঠীগত সংহতির অভাব মুসলিম সমাজকে জাতি, ভাষা ও মতাদর্শের বিভাজনে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিয়েছে।

ফিলিস্তিন সংকট আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, মুসলিম উম্মাহর দুর্বলতা—তাদের নিষ্ক্রিয়তা, অকার্যকর নেতৃত্ব এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস।

একদিকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনে নারী, শিশু ও নিরীহ মানুষ হত্যা চলছে, অন্যদিকে বিশ্ব শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর নীরবতা ও দ্বিচারিতা সেই দুঃসহ বাস্তবতাকে আরও নির্মম করে তুলেছে। বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ফিলিস্তিন যাদের হৃদয়ের অংশ হওয়ার কথা, সেই রাষ্ট্রগুলোর বেশিরভাগই আজ নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায়। কেউ কেউ আবার ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে, যা মুসলিম উম্মাহর একতার অভাব ও চরম দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি।

ইসরায়েলি আগ্রাসন শুধু সরাসরি সহিংসতায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি কাঠামোগত সহিংসতা, যেখানে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি জড়িত। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনপন্থী প্রস্তাবগুলোতে নিয়মিত ভেটো দিয়ে, ইসরায়েলের দখলদারতাকে বৈধতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকারের নামে এই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ মুসলমানদের প্রতি আন্তর্জাতিক অমানবিকতারই প্রতিফলন।

মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আজ বহুমাত্রিক দুর্বলতা দৃশ্যমান। তারা জাতি, ভাষা ও মতাদর্শের বিভাজনে এতটাই আবদ্ধ যে, একত্র হয়ে মানবিক সংকটে প্রতিক্রিয়া দেখাতেও ব্যর্থ। কার্যকর কূটনীতি, অর্থনৈতিক চাপ বা আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে নেই কোনো ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ। পাশাপাশি, প্রযুক্তি ও সামরিক দিক থেকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এখনো পশ্চাৎপদ। আধুনিক বিশ্বের নেতৃত্ব নির্ভর করে তথ্য প্রযুক্তি, মিডিয়া ও সাইবার সক্ষমতার ওপর যেখানে মুসলিম সমাজ এখনো প্রান্তিক।

এই প্রান্তিকতার সুযোগ নিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তায় তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। জাতিসংঘে ভেটো প্রয়োগের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবিগুলো দমন করছে। একদিকে মানবাধিকারের বুলি, অন্যদিকে দখলদারতার প্রতি প্রশ্রয় এই দ্বিচারিতা মুসলমানদের জন্য চরম হতাশাজনক।

পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘ দিন ধরে মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করতে নানা কৌশল নিয়েছে ইসলামি প্রতিরোধকে সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করা, মুসলিম ভূখণ্ডে সংঘাত তৈরি করা, আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলমানদের আত্মপরিচয়কে দুর্বল করা। এই পরিকল্পনার প্রতিফলন আমরা ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি।

তবে এই অন্ধকারে আশার আলোও বিদ্যমান। ইতিহাস বলছে, যেকোনো শোষিত জনগোষ্ঠী তাদের সাংস্কৃতিক চর্চা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহাসিক স্মৃতিকে অবলম্বন করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। ফিলিস্তিনের শিশুদের সাহস, নারীদের প্রতিরোধ এবং তরুণদের আত্মত্যাগ—সবই প্রমাণ করে, ইসলামী চেতনা এখনও জীবিত আছে। এটি একটি ‘প্রতিরোধ সংস্কৃতি’ (Culture of Resistance), যা কেবল প্রতিরক্ষার নয়, বরং আত্মপরিচয় সংরক্ষণেরও হাতিয়ার।

এখন সময় আত্মজাগরণের। মুসলিম সমাজকে নিজেদের দুর্বলতা বুঝে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রয়োজন ইসলামী মূল্যবোধ ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা। অর্থনৈতিক সক্ষমতা গড়ে তুলে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের ন্যায্য অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি, নিজেদের মিডিয়া, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যেখান থেকে সত্য উচ্চারিত হবে এবং ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া সম্ভব হবে।

মো. আসিফ হাসান রাজু: শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, এইউবি।

Email:ahrazu@aub.ac.bd