মার্কিন শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে

আব্দুল্লাহ কাফি
০৬ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
মার্কিন শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে

ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতিকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এরই মধ্যে কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এর প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়াতে কূটনীতিক চ্যানেলের তৎপরতা বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে শুল্ক বাড়িয়েছে, তা কমাতে ট্রাম্প সরকারের সঙ্গে আলোচনা বাড়ানোরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এর পাশাপাশি রপ্তানি বাড়াতে তথা বাজার সম্প্রসারণে অন্যান্য দেশ খোঁজা যেতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার অনেক বড়। বাংলাদেশের জন্য এ বাজারের ভালো বিকল্প যে আপাতত নেই, সেটিও তারা স্বীকার করছেন।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ উদ্যোগী হতে পারে এবং তাদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো ভূমিকা নেওয়া উচিত।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে যতটা কমানো যায়, ততটাই ভালো। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির গড় শুল্ক ১৫.২ শতাংশ। আমেরিকাতে শুল্ক ধরা হয় পণ্যের ধরন অনুযায়ী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যুুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, যন্ত্রপাতি ও পোশাক শিল্পের জন্য যেসব পণ্য আমদানি করে, এগুলোর অধিকাংশই শুল্কমুক্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১ শতাংশ। বাড়তি শুল্কারোপের কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প চাপে পড়বে।

ফারুক হাসান বলেন, রাতারাতি বিকল্প বাজার পাওয়া সম্ভব না। তবে বাজার সম্প্রসারণে উদ্যোগী হতে হবে। নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বাড়তি শুল্ক কমানোর পাশাপাশি চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশে বাড়াতে হবে। এতে ঘাটতি কিছুটা কমে আসবে।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে, যাতে শুল্ক কমানো যায়। অন্তত পাশর্^বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বাড়ানোর ফলে ক্রেতারা পণ্যের দাম কমাতে চাপ সৃষ্টি করবে। তাদের পছন্দ অনুযায়ী দামে না পেলে পাশর্^বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ক্রেতারা যেখানে কম দাম পাবে, সেদিকেই ঝুঁকবে। এতে করে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে টিকে থাকা কঠিন হবে বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।

ফজলে শামীম এহসান বলেন, চাইলেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের মতো অন্য বাজার পাওয়া যাবে না। এ বাজারকে ধরে রাখতে হবে। এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাবে না। যতটা পারা যায়, শুল্ক কমাতে চেষ্টা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এখন চীনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে করে চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশে বাড়ানো যায়। এ ক্ষেত্রে তিনি দ্রুত সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শুল্কযুদ্ধ কোনোভাবে আধুনিক বিশ্বে কাম্য নয়। এই শুল্ক আমেরিকার অর্থনীতিতে খুব বেশি সাফল্য বয়ে আনবে না। আমাদের রপ্তানি করা পণ্যে প্রফিট মার্জিন অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, এই পণ্যগুলো মেইড ইন ইউএসএ (যুক্তরাষ্ট্র) হবে। তা সম্ভব নয়। কারণ এই শিল্পগুলো শ্রমঘন ইন্ডাস্ট্রি। আমি মনে করি, শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে কতটুকু স্থির থাকবে ইউএসএ প্রশাসন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

বিকেএমইএর এই নির্বাহী সভাপতি বলেন, শুরুতে আমাদের ওপর একটা ঝড় আসবে। কারণ, বায়াররা সব সময়ই সুযোগসন্ধানী। তারা আমাদের পণ্যের দাম কমানোর চেষ্টা করবে। এটা যদি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি; সরকারের নীতিগত সাপোর্ট নিয়ে যদি টিকে থাকতে পারি, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল আমরা পাব। তিনি বলেন, এই শুল্কারোপ শুধু আমাদের ক্ষতি করবে না, মার্কিন নাগরিকদের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এই প্রভাব পড়বে আমেরিকার অর্থনীতিতে চাহিদা কমার কারণে। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, শুল্ক আরোপ করায় আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা আসবে। সব কিছুর দাম বাড়বে। এতে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমতে পারে। ফলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কমার আশঙ্কা রয়েছে।

ড. জাহিদ বলেন, বাংলাদেশকে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক কমানোর যুক্তি তুলে ধরতে হবে, যতে দ্রুত বাড়তি শুল্ক কমানো যায়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আমাদের সময়কে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অনেক বড় বাজার। এই বাজারের গুরুত্ব সবসময় থাকবে। এর বিকল্প বাজার তৈরি করা কঠিন। এ ছাড়া নতুন বাজার সময়সাপেক্ষ বিষয়ও বটে। তবে চাপে পড়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা হয়তো এখন নতুন বাজার খুঁজবেন। তিনি বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে বড় কারখানাগুলোর বেশি সমস্যা না হলেও ছোট-মাঝারি কারখানাগুলো এই ধাক্কা কাটাতে সক্ষম হবে না। তাই উচিত হবে, দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসা। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের উচিত হবে ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, যেন তারা ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে না দেন।