বাংলাদেশ ও বেইজিংয়ের সম্পর্কের ভারসাম্য

সাইমন মোহসিন
৩০ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বাংলাদেশ ও বেইজিংয়ের সম্পর্কের ভারসাম্য

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর এমন এক সময়ে হয়েছে যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আগস্ট বিপ্লবের পর বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। তবে এই সফরকে সম্পূর্ণ নতুন সংযোগ হিসেবে দেখা হবে ভুল। সফরে স্বাক্ষরিত বেশির ভাগ চুক্তিই আগের সরকারের সময় নির্ধারিত হয়েছিল, যা চীনের কৌশলগত ধারাবাহিকতা প্রকাশ করে।

চীন বরাবরই রাজনৈতিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভর না করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ঢাকা সফর করেন, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। এটি চীনের নীতিগত অবস্থানকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেÑ তারা নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে নয়, বরং বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এবারও চীন মূলত অর্থনৈতিক সহযোগিতা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, যা কোনো একক সরকারের প্রতি নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।

এই সফরের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এটি এমন সময় হয়েছে যখন বাংলাদেশের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। আগস্ট বিপ্লবের পর বাংলাদেশ নতুন কূটনৈতিক কৌশল নির্ধারণের চেষ্টা করছে, যেখানে চীনের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউনূসের সফর সেই প্রচেষ্টার একটি অংশ। তবে এই আবেগতাড়িত মনোভাব যেন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।

এই সফরে ড. ইউনূসের প্রতি তথা বাংলাদেশের প্রতি চীনের আন্তরিক আচরণ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের বিবর্তন ও কৌশলের অংশ। মোংলা বন্দর উন্নয়ন এবং চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা এর বড় উদাহরণ। যদিও এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে, এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।

বাংলাদেশ এবারও ‘এক-চীন’ নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, যা আগে থেকেই বাংলাদেশের নীতির অংশ। তবে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এটি নতুন কূটনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে, বাংলাদেশ ‘গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ (জিডিআই)-এর প্রতি আগ্রহ ও ইতিবাচক মন্তব্য, যা চীনের আন্তর্জাতিক ভূমিকার প্রতি বাংলাদেশের ইতিবাচক মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি বদলাচ্ছে, এবং বাংলাদেশ তার কৌশলগত অবস্থান নতুনভাবে নির্ধারণ করতে চাইছে।

এই সফরের অন্যতম মূল দিক ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার এবং বিনিয়োগকারী। এই সফরে বেশ কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের কথা আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে মোংলা বন্দরের উন্নয়ন, রেল সংযোগ বৃদ্ধি, এবং বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

তবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কিছু প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক ও বাস্তবায়নের ধীরগতির বিষয়টি রয়েই গিয়েছে। এ সফরে নতুন কিছু প্রকল্প ঘোষণা করা হলেও মূলত বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিই ছিল কেন্দ্রবিন্দু।

এ সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি। চীন বাংলাদেশে হাসপাতাল নির্মাণ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটি শুধু বাংলাদেশের জনগণের জন্যই নয়, বরং ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রযুক্তি খাতে চীনের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। চীন ইতোমধ্যে বাংলাদেশের আইসিটি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে এবং ৫জি প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা দিচ্ছে। তবে এই সহযোগিতা পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ও তাদের উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

যমুনা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ‘হাইড্রোলজিক্যাল ইনফরমেশন শেয়ারিং’ চুক্তি ইতিবাচক হলেও, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি জল-নিরাপত্তার জন্য আরও সুসংগঠিত সহযোগিতা দরকার।

তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ বাংলাদেশের বিকল্প অংশীদারত্বের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। তবে এটি কূটনৈতিকভাবে সংবেদনশীল একটি বিষয়, কারণ এতে ভারতের প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র বাঁধ প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে এখনও কোনো কার্যকর চুক্তি হয়নি, যা বাংলাদেশের জলবায়ু নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক।

রোহিঙ্গা সংকটেও চীনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। চীন এ সমস্যার সমাধানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে, তবে বাস্তব অগ্রগতি এখনও সীমিত।

এ সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ধারাবাহিকতাকে নিশ্চিত করেছে। এটি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে সংহত করতে ভূমিকা রাখলেও তাৎক্ষণিক বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি, সেটি এ সফরে হবে এমনটা কথাও ছিল না। এ সফরের লক্ষ্যই ছিল বিদ্যমান সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সহযোগিতার ভিত্তি শক্তিশালী করা।

সফরটিকে ব্যর্থ বলা ভুল হবে, কারণ এটি কৌশলগত স্থিতিশীলতার প্রতিফলন। এটি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করেছে এবং চীনের দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার বার্তা বহন করেছে। তবে বাংলাদেশকে এই সম্পর্ক কৌশলগতভাবে পরিচালনা করতে হবে, যাতে চীনের পাশাপাশি অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। সফরটি একটি নতুন বাস্তবতাও প্রকাশ করেছেÑ যেখানে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আরও ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিতে হবে। চীনের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক এবং কৌশলগতভাবে উপকারী হলেও, এশিয়ার অন্যান্য শক্তি যেমন ভারত, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও বাংলাদেশকে বিবেচনায় রাখতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চীন ও ভারতের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান, তার মধ্যে বাংলাদেশকে একটি সুস্থ ভারসাম্য বজায় রেখে এগোতে হবে, যাতে কোনো নির্দিষ্ট পক্ষের প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকে না পড়ে।

এ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও সুসংহত করেছে এবং বাংলাদেশকে নতুন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সুযোগের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। তবে ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক কীভাবে বিকশিত হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করবে বাংলাদেশের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতার ওপর।


সাইমন মোহসিন : রাজনৈতিক ও আন্তজাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক