এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা বাংলাদেশ কি অর্জন করতে পেরেছে?
বাংলাদেশ এখনও এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। কোনো সেক্টরেই বাংলাদেশের ধনাত্মক অর্জন নেই। Macro লেভেলে তো নয়ই, Micro লেভেলেও নয়। কোনো সেক্টরেই বাংলাদেশ ধনাত্মক কোয়াড্রেন্টে (1st Quadrant where both X & Y Coefficients are positive) প্রবেশ করতে পারেনি। সেটা প্রমাণের জন্য আমি অর্থনীতির নতুন একটা তত্ত্ব আবিষ্কার করেছি, যার নাম দিয়েছি Development Vs Negativity theory of Development. আমার রচিত রাজনীতি, সুশাসন ও উন্নয়ন নামের গ্রন্থে সেটি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনীতি সমিতির বিগত দ্বিবার্ষিক সম্মেলনেও আমি সেটি উপস্থাপন করেছি। তা ছাড়া একটি জাতীয় দৈনিকে ৩ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখের সংখ্যায় [উন্নয়ন বনাম উন্নয়নের ঋণাত্মক তত্ত্ব] শিরোনামে সেটা প্রকাশিত হয়েছে। সেই তত্ত্ব মাধ্যমে আমি আরও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক মাথাপিছু আয়ের নিরিখে বাংলাদেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা করাও সঠিক হয়নি।
এলডিসি হিসেবে আমরা যদি বাংলাদেশকে ১৯৯০-পূর্ববর্তী এবং ১৯৯০-পরবর্তী যুগে ভাগ করে তুলনামূলক পর্যালোচনা করে পজিটিভ অর্জন খুঁজতে থাকি তা হলে আমরা কী পাব?
১. ১৯৯০-পূর্ববর্তী যুগে ঢাকা শহরে ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর ছিল। আর ১৯৯০-পরবর্তী যুগে শুধু ঢাকা সেনানিবাস ছাড়া অন্য কোথাও ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর নেই।
২. গণপরিবহন খাতে ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে যে সুশৃঙ্খল অবস্থা বিদ্যমান ছিল, ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে সে খাতে সর্বোচ্চ মাত্রার বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। মহাসড়কে ৬ লক্ষাধিক যানবাহন চলছে ফিটনেস ছাড়া। মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং মোটরসাইকেলের যথেচ্ছ ব্যবহার গণপরিবহন ব্যবস্থাকে বিপজ্জনক করে তুলেছে।
৩. প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে ব্যাপক দুর্নীতির তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাত্রা বাড়তে থাকে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের মাত্রাও বাড়তে থাকে। ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রকল্প গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতির মাধ্যমে প্রকল্পের অর্থ লুটপাট করা।
৪. রেল খাতে ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে ব্যাপক দুর্নীতির তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে রেল যোগাযোগ খাতে দুর্নীতির মাত্রা বাড়তে থাকে। ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে রেল যোগাযোগ খাতে দুর্নীতির মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
৫. শিক্ষা খাতে ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে যেরূপ শৃঙ্খলা বিদ্যমান ছিল, ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে সেটা আর থাকেনি। ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি-দলীয়করণ, কারিকুলামভিত্তিক বস্তা পচা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে চরম সংকটে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
৬. মানবসম্পদ উন্নয়ন : ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অবস্থান ছিল, ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেটা ধরে রাখতে পারেনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মাদক সম্রাট বদিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সমগ্র দেশে মাদকের অবাধ বিস্তৃতি ঘটিয়ে যুব সমাজের চরিত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবকদের নিয়োগ না করে ভারতীয় এবং শ্রীলংকার যুবকদের নিয়োগে অনেক বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশ সরকার নিজেও পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ২য় টার্মিনাল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ না দিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে। কাজেই ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন কোনো অর্জন নেই।
৭. বিশ্বব্যাংক একদিকে বলছে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, অন্যদিকে বলছে বাংলাদেশের ১৭ কোটি লোকের মধ্যে ১২ কোটি ১০ লাখ লোক স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারে না অর্থাৎ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ক্রয় করার সামর্থ্য তাদের নেই (Atlas of Sustainable Development Goals 2023– একটি জাতীয় দৈনিক, ৭ জুলাই, ২০২৩)। বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে তার ৭১ শতাংশ লোক কেন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনে খেতে পারবে না?
৮. মাথাপিছু আয় : সুশাসন কায়েম করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় ৯১ হাজার ডলারকে ছাড়িয়ে যেতে পারত। অপশাসনের কারণে বাংলাদেশের Gross Domestic Product or Gross Domestic income-এর বৃহদাংশ (৬০-৭৫%) প্রভাবশালী ৫-১০% লোকের হাতে চলে গেছে। ৫-১০% লোকের বিশাল সম্পদকে ৯০% লোকের মাঝে অঙ্ক কষে ভাগ করে দেখানো হলে ৯০% লোকের ভাগ্যের তো কোনো পরিবর্তন হবে না। ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে ধনী-গরিবের মাঝে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে প্রজাতন্ত্রের সম্পদের যথেচ্ছ লুণ্ঠনের কারণে ধনী-গরিবের বৈষম্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে দেশের সামগ্রিক সম্পদের ৭৫% মাত্র ১০% লোকের হাতে কুক্ষিগত, সে দেশকে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ করানোর কোনো সুযোগ নেই।
৯. জলবায়ু পরিবর্তন : ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশে জলবায়ুর অবস্থা ১৯৯০-পরবর্তী সময়ের চেয়ে অনেক ভালো ছিল।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
১০. ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়ে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংকগুলোতে লুটতরাজ চালিয়ে হাজার লাখ কোটি টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকেরই গভর্নর। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক অংশও শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন আত্মসাৎ করে।
১১. বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রায় বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ গ্রহণ করে থাকে। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে সেই ঋণের সুদহার বেড়ে যায়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সেই সুদের হার আরও বেড়ে যাবে। সেরূপ ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বাড়তি চাপের সম্মুখীন হতে হবে।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ যে ক্ষেত্রে ১৯৯০-পূর্ববর্তী এলডিসির অবস্থানই ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে ধরে রাখতে সক্ষমতার পরিচয় দেয়নি, সে ক্ষেত্রে কী করে ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে এলডিসির চ্যাপ্টার অতিক্রম করে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে?
এ বিষয়ে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একটি জাতীয় দৈনিকে বলেন, ২০২৬ সালেই এলডিসি উত্তরণ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত। এখন উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে হবে [সূত্র-একটি জাতীয় দৈনিক-১৪ মার্চ-২০২৫]। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং সক্ষমতা না থেকে থাকলে বাংলাদেশ কী করে এলডিসি থেকে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে উন্নয়নশীল দেশে স্থান করে নেবে?
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, আমাদের ব্যবসায়ীরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত নন। গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সময়ে শুল্ক সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা হ্রাস পাবে [সূত্র- একটি জাতীয় দৈনিক-১৬ মার্চ-২০২৫]। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা যদি তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে ৮ বিলিয়ন ডলার দাবি করে বসে তখন সরকার কি তাদের ৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে? আর সরকারের কী দায় পড়েছে যে উন্নয়নশীল দেশের তকমা গায়ে মাখার শাস্তি হিসেবে তাকে প্রতিবছর ৮ বিলিয়ন ডলার করে ব্যবসায়ীদের পরিশোধ করতে হবেÑ তাও আবার আইএমএফ কিংবা অন্য কোনো দাতা সংস্থা থেকে ঋণ করে?
‘শেখ হাসিনা গাজার মতো বিধ্বস্ত এক দেশ রেখে গেছেন’- গার্ডিয়ানকে অধ্যাপক ইউনূস [সূত্র- একটি জাতীয় দৈনিক -১১ মার্চ, ২০২৫]। গাজা তো বসবাসের অনুপযোগী এক বিধ্বস্ত নগরী। গাজাকে এলডিসির মর্যাদা দেওয়াও সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে যদি গাজার সঙ্গেই তুলনা করা হয় তা হলে বাংলাদেশ কী করে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের দাবিতে অটল থাকে?
এ টি এম মোস্তফা কামাল : অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব