আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে আস্থার সংকট কাটছে

জিয়াদুল ইসলাম
২৭ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে আস্থার সংকট কাটছে

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। ফলে এ খাতে ফের আমানতকারী হিসাব ও আমানত দুই-ই বাড়ছে। গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে এ খাতে আমানতকারী হিসাব বেড়েছে ২৬ হাজারেরও বেশি। আর ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ২৮ হাজার। অন্যদিকে তিন মাসে নতুন আমানত বেড়েছে প্রায় ১৯১ কোটি টাকা। এর আগে টানা পৌনে দুই বছর রেকর্ড পরিমাণ আমানতকারী হারিয়েছিল খাতটি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের অনিয়ম, জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মূল্যস্ফীতি চড়তে থাকায় ব্যক্তি আমানতকারীরা হিসাব গুটিয়ে ফেলছিলেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করায় মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখলে অপেক্ষাকৃত বেশি সুদ পাওয়া যায়। সুদহার বাজারভিত্তিক করার পর এ খাতে সুদের হার আরও বেড়েছে। ফলে ঝুঁকছেন আমানতকারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালের জুনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯১টি। একই বছরের ডিসেম্বর শেষে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ১৩ হাজার ৮৭৫টিতে। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে সার্বিক আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার ৯৮৪টি। অন্যদিকে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে সার্বিক আমানতকারী হিসাব বেড়েছে প্রায় ২৬ হাজার ২৮৭ জন।

এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত এ খাতে ধারাবাহিক আমানতকারীদের হিসাব কমেছিল। ওই পৌনে দুই বছরে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলে আমানতকারী হিসাব কমেছিল প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৬৮ জন। অর্থাৎ এ খাতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমানতকারীর সংখ্যা ৫ লাখ ৭০ হাজার ১৯৪ জন। যা কমতে কমতে গত বছরের জুনে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯১ জনে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ২৫ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে এ খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ১৯১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আগের প্রান্তিকে এ খাতে আমানত কমেছিল প্রায় ৬৮ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের বেশির ভাগই ঢাকা বিভাগে। এর পরিমাণ প্রায় ৯২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, রাজশাহীতে শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ, খুলনায় শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ, সিলেটে শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ, ময়মনসিংহে শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ, রংপুরে শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ এবং বরিশালে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ রয়েছে।

অন্যদিকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৭৬ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। তিন মাস আগে, গত সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৭৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতে ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে আমানত বাড়েনি।

বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মে জর্জরিত এ খাতে খেলাপি ঋণও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। এরও তিন মাস আগে, গত জুন পর্যন্ত এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা বা ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। সেই হিসাবে ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ।

বর্তমানে দেশে ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই রয়েছে তারল্য সংকটে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এক ডজনের বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন নাজুক, যাদের ৬০ শতাংশের বেশি ঋণই খেলাপি।