বাংলাদেশি এনআইডি দিয়েই এস আলমের লাইসেন্স নবায়ন
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন দেশের আর্থিক খাতে বহুল আলোচিত শিল্প গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকলেও বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেই তিনি এবং তার পরিবার ও সহযোগীরা ২২৯ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক লাইসেন্স নবায়ন করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ থেকে। এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। তবে এস আলম ও তার পরিবারের নাগরিকত্ব ত্যাগ করা এবং বাংলাদেশি এনআইডি ব্যবহার করে ব্যবসায়িক লাইসেন্স নবায়নের বিষয়ে অন্ধকারে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলেছেন, এ বিষয়ে এখনও তাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি। তারা সরকারি কোনো নির্দেশনাও পাননি বলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে সম্পত্তি হস্তান্তর বন্ধ রেখেছেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আটটি সার্কেলের মধ্যে ১ নম্বর সার্কেলে এস আলমের কোনো লাইসেন্স পাওয়া যায়নি। ২ নম্বর সার্কেলে সাইফুল আলম মাসুদের নামে দুটি লাইসেন্স রয়েছে। পরিবহন এজেন্সি দুটি প্রতিষ্ঠানের নামই এস আলম সার্ভিস। ৩ নম্বর সার্কেলে ২২৪, ৪ নম্বর সার্কেলে মেসার্স এস আলম সার্ভিস ও কর্ণফুলী প্রাকৃতিক গ্যাসের নামে দুটি এবং ৫ নম্বর সার্কেলে মেসার্স এস আলম সার্ভিস নামে একটি লাইসেন্স রয়েছে। ৬ থেকে ৮ নম্বর সার্কেলে এস আলম বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কোনো লাইসেন্স নেই বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দপ্তর।
জানা গেছে, ৩ নম্বর সার্কেলের ২২৪টি লাইন্সেসের মধ্যে ১৩টি লাইসেন্সের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ ও দুটি তার ছেলে আহসানুল আলমের নামে। এস আলমের নামে যেসব লাইসেন্স সেগুলো হলো- ওশ্যান রিসেটিস, মেসার্স এস আলম অ্যান্ড কোং, চেমন ইস্পাত লিমিটেড, সোনালি কার্গো লজিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড, এস আলম ট্রানক টার্মিনাল লিমিটেড, এস আলম ট্রেডিং কোং (প্রা.) লিমিটেড, এস আলম ব্যাগ মেনুফ্যাকচারিং মিল লিমিটেড, এস আলম সয়াসিড এক্সট্রাকশন প্ল্যান্ট লিমিটেড, এস আল সার্ভিস (আন্দরকিল্লা), এস আলম সার্ভিস (আন্দরকিল্লা), এস আলম সার্ভিস (দক্ষিণ বাকলিয়া)। মেসার্স জেনেসিস এন্টারপ্রাইজ ও জেনিসিস টেক্সাইল এক্সেসরিজ অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেড ছেলে আহসানুল আলমের নামে। বাকি সব লাইসেন্স এস আলম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে।
দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় মাফিয়া গ্রুপ ব্যাংকিং খাতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর সপরিবারে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিল। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রত্যাহার করেন এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তাদের তিন ছেলে আহসানুল আলম, আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম মাহির। একই দিন বিদেশি নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসের (পারমানেন্ট রেসিডেন্সিয়াল) অনুমোদন পেয়েছিল পরিবারটি। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈচারাচার সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আমাদের সময়কে জানান, এখন যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক নয়; তাই এসব লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। আমাদের কাছে কেউ এখনও পর্যন্ত অভিযোগ করেনি, তাই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে এস আলম পরিবারের সম্পত্তি হস্তান্তর বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী সদস্য ড. খন্দকার আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারী যদি শতভাগ বিনিয়োগ করে তাহলে কোম্পানি খুলে বিডা থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। বিনিয়োগকারী যে দেশের নাগরিক সে দেশের ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে সব কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে এস আলম যেহেতু আগেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছিল, এ ক্ষেত্রে তাদের বিষয়টি ভিন্ন।
এস আলমের সহযোগী ও অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সগুলো হলো- মডার্ন প্রপার্টিজ লিমিটেড, প্রদাদ প্যারাডাইস রিসোর্টস লিমিটেড, বেরিং সী লাইন্স, মেসার্স হাসান আবাসন প্রাইভেট লিমিটেড, এস আলম পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড, টুলাইট করপোরেশন, টেকওয়ে বিজনেস লাইন, নর্থ বে ট্রেড লিং, মোমেনটাম বিজসেন সেন্টার, নাফ ট্রেডিং, নুর ট্রেডিং, প্রিসিয়াস ট্রেড সেন্টার, ওয়ান্ডারল্যান্ড ট্রেডিং হাউস, রাইজিং সান এন্টারপ্রাইজ, রংধনু এন্টারপ্রাইজ, ট্রেডিং অর্যাকল, জিএম এন্টারপ্রাইজ, গ্লোজি ট্রেডিং হাউস, ট্রেডিং হাউস পার্ল, মাল্টি ট্রেডিং করপোরেশন, মনির ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ফেয়ারি টেল ইন্টারন্যাশনাল, এক্সপ্রেস মার্সেন্ট সার্ভিস, গ্লোরিয়াস এক্সেপোস ট্রেডার্স, এমআরসি বিজনেস হাউস, মডার্স ট্রেড অ্যান্ড বিজনেস হাউস, মনসুন এন্টারপ্রাইজ, নিউ ওয়েভ করপোরেশন, নর্দান ট্রেডিং করপোরেশন, মাবুদ ট্রেডিং করপোরেশন, মাউনটেন ট্রেডার্স, মার্ভেলাস ট্রেডিং কর্নার, এম এইচ ট্রেডিং, ওয়াল বিজনেস করপোরেশন, মুছা এন্টারপ্রাইজ, ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েটস, জিনিয়াস ট্রেডিং, এক্সিসটেস ট্রেড এজেন্সি, মোর্শেদ ট্রেডার্স, লাক্সারি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জামশেদ এন্টারপ্রাইজ, ভেনাস ট্রেডিং, জাস ট্রেডিং, ইউনিয়ন ট্রেডিং হাউস, ইনোভেশন ট্রেড, লিজিয়ান ট্রেডিং, অ্যাপারটুর ট্রেডিং হাউস, জাস্ট রাইট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ইমপ্রেস করপোরেশন, হাছান ট্রেডিং করপোরেশন, অ্যাডভান্স কমিউলেটিভ বিজনেস হাউস, ট্রেডিং কর্নার মার্চেন্ট, দি এক্সচেঞ্জ করপোরেশন, আলফা ট্রেডিং, দ্যা প্রোগ্রেসিভ করপোরেশন, মেসার্স আবদুল আউয়াল অ্যান্ড সন্স, ব্রাইট ইন্টারন্যাশনাল, ডটকম বিডি, স্পটলাইট করপোরেশন, আকবর ইন্টারন্যাশনাল, ট্রেডিং হাউস পিসোর্স, ট্রেন্ড ইন্টারন্যাশনাল বিল্ড, ট্রেডিং হাউস গ্যালাক্সি, ব্লু স্কাই ট্রেডার্স, এপেক্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ব্রাইট বিজনেস টেক, মুনলাইট ট্রেডিং হাউস, মাসুম ট্রেডিং হাউস, রেভেল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসিফিক রিম বিজনেস হাউস, নব ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নরিনকো ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, আনছার এন্টারপ্রাইজ, ব্লু ডাইমন্ড ইন্টারন্যাশনাল, নওরিন এন্টারপ্রাইজ, এআর এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ফাইরোজ ট্রেডিং, ট্রেডিং ইনভেটিভ, সেল্ফ টেক জোন, ট্রান্সপ্যারেন্সি ট্রেডিং হাউস, ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল কানেক্ট, টাইটান ইন্টারন্যাশনাল, টপ চয়েস ট্রেডিং করপোরেশন, মেসার্স তৈয়ব অ্যান্ড ব্রাদার্স, ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজ, ডে ড্রিম বিজনেস হাউস, মেসার্স শেঠ ট্রেডিং, ব্লু মুন ইত্যাদি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (সিআরও) এসএম সরওয়ার কামাল জানান, আটটি সার্কেলের মধ্যে চারটি সার্কেলে এস আলমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স পাওয়া গেছে। এ পদে তার যোগদানের আগেই এস আলমের এসব লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে।
এদিকে সাইফুল আলম মাসুদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইডে সচল রয়েছে। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিস থেকে এনআইডি কার্ড যাচাই করে সত্যতা নিশ্চিত করেছেন কর্মকর্তারা।