স্টারলিংক মহাকাশ থেকে ইন্টারনেট বিপ্লব
বিশ্বেজুড়ে স্টারলিংকের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন চার কোটি। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে দ্রুত স্টারলিংকের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশেও ব্যবসা করতে আগ্রহী স্টারলিংক। বিশ্বজুড়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে স্টারলিংক (Starlink)। স্পেসএক্স (SpaceX) পরিচালিত এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর জন্যও দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা। কিন্তু কীভাবে কাজ করে স্টারলিংক? এটি কি সত্যিই প্রচলিত ব্রডব্যান্ডের চেয়ে উন্নত? উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এর কী প্রভাব থাকবে? এসব নিয়ে ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজহারুল ইসলাম অভি
স্টারলিংক কী?
স্টারলিংক হলো একটি স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা, যা ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সাধারণত আমরা অপটিক্যাল ফাইবার বা মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করি, যেখানে তার বা টাওয়ারের মাধ্যমে সিগন্যাল পৌঁছায়। কিন্তু স্টারলিংক এ ক্ষেত্রে একদমই ভিন্ন। এটি লো আর্থ অরবিট (LEO) স্যাটেলাইট ব্যবহার করে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়, যা উচ্চগতির ও কম ল্যাটেন্সির ইন্টারনেট সরবরাহ করতে সক্ষম। বর্তমানে স্টারলিংকের ৫,০০০+ সক্রিয় স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে রয়েছে এবং এটি আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স ২০১৫ সালে স্টারলিংক প্রকল্পের ঘোষণা দেয় এবং ২০১৮ সালে প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে। বর্তমানে এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহ করছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত ও অনুন্নত অঞ্চলে, যেখানে প্রচলিত ব্রডব্যান্ড সহজলভ্য নয়। স্টারলিংকের লক্ষ্য হলো স্বল্প দামে সবার জন্য উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা।
কীভাবে কাজ করে স্টারলিংক?
স্টারলিংকের মূল কার্যপদ্ধতি তিনটি ধাপে বিভক্ত-
স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক : স্টারলিংকের ছোট, কম ওজনের স্যাটেলাইটগুলো লো আর্থ অরবিটে (৫৫০ কিমি. উচ্চতায়) স্থাপন করা হয়। এগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত ডাটা পাঠায় এবং গ্রহণ করে।
গ্রাহক টার্মিনাল (Dish & Router) : স্টারলিংকের ব্যবহারকারীদের বাড়িতে একটি বিশেষ ডিশ (Dish) এবং রাউটার দেওয়া হয়, যা সরাসরি স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ইন্টারনেট সরবরাহ করে।
গ্রাউন্ড স্টেশন : স্যাটেলাইটগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে বেশ কিছু গ্রাউন্ড স্টেশন রয়েছে, যা ইন্টারনেট ডাটা রিসিভ করে এবং ব্যবহারকারীদের সরবরাহ করে। স্টারলিংকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এই সিস্টেমের জন্য কোনো কেবল বা ভূ-ভিত্তিক অবকাঠামো দরকার হয় না, ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সহজেই ইন্টারনেট পৌঁছানো সম্ভব।
স্টারলিংকের সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্টারলিংকের প্রভাব
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্টারলিংক হতে পারে একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি। কারণ এসব দেশের অনেক অঞ্চল এখনও উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে।
গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় উন্নয়ন : যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল বা ফাইবার অপটিক নেই, সেখানে টেলিমেডিসিন ও অনলাইন শিক্ষা সহজ হবে।
ব্যবসা ও বাণিজ্যের সুযোগ বৃদ্ধি : স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিশ্ববাজারের সঙ্গে সহজেই সংযুক্ত হতে পারবেন।
ডিজিটাল বিভাজন কমানো : শহর ও গ্রামের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের যে বৈষম্য রয়েছে, সেটি কমিয়ে আনতে পারে।
আরও পড়ুন:
জলবায়ু সম্মেলনের আদ্যোপান্ত
সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ : কিছু সরকার স্টারলিংকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে, কারণ এটি সেন্সরশিপ এড়াতে পারে এবং গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
প্রথাগত ব্রডব্যান্ড বনাম স্টারলিংকের পার্থক্য
সংযোগ পদ্ধতি/স্টারলিংক : স্যাটেলাইট
প্রচলিত ব্রডব্যান্ড : অপটিক্যাল ফাইবার/মোবাইল নেটওয়ার্ক
গতি/ স্টারলিংক : ৫০-২৫০ Mbps
প্রচলিত ব্রডব্যান্ড : ১০০-১০০০ Mbps (ফাইবার)
ল্যাটেন্সি/ স্টারলিংক : ২০-৪০ মিলিসেকেন্ড
প্রচলিত ব্রডব্যান্ড : ৫-২০ মিলিসেকেন্ড
ইনস্টলেশন খরচ / স্টারলিংক : বেশি ($৪৯৯+)
প্রচলিত ব্রডব্যান্ড : তুলনামূলক কম
উপযোগী এলাকা/ স্টারলিংক : গ্রাম ও দুর্গম স্থান
প্রচলিত ব্রডব্যান্ড : শহর ও সংযুক্ত এলাকা
আবহাওয়ার প্রভাব / স্টারলিংক : তুলনামূলক বেশি
প্রচলিত ব্রডব্যান্ড : কম
আরও পড়ুন:
এবারের সম্মেলনে গুরুত্ব পাবে যেসব বিষয়
স্টারলিংকের সুবিধা
প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট : যেখানে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট পৌঁছানো সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল, সেখানে স্টারলিংক সহজেই ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে পারে।
উচ্চগতি ও কম ল্যাটেন্সি : প্রচলিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের তুলনায় স্টারলিংকের ল্যাটেন্সি অনেক কম (২০-৪০ মিলিসেকেন্ড), যা ভিডিও কল ও অনলাইন গেমিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্যোগের সময় কার্যকর : ভূমিকম্প, বন্যা বা অন্যান্য দুর্যোগের সময় যখন মোবাইল নেটওয়ার্ক বা অপটিক্যাল ফাইবার ব্যর্থ হয়, তখন স্টারলিংক একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হতে পারে।
দ্রুত ইনস্টলেশন : শুধু ডিশ ও রাউটার বসিয়ে খুব সহজেই সংযোগ চালু করা যায়।
স্টারলিংকের চ্যালেঞ্জ
মূল্য বেশি : স্টারলিংকের হোম কিটের দাম ৪৯৯ থেকে ৫৯৯ টাকা এবং মাসিক সাবস্ক্রিপশন ১১০ থেকে ১২০ টাকা, যা অনেকের জন্য ব্যয়বহুল।
বাতাস ও আবহাওয়ার প্রভাব : ভারি বৃষ্টি বা তুষারপাতের সময় স্টারলিংকের সংযোগে সমস্যা হতে পারে।
বেশি বিদ্যুৎ খরচ : অন্যান্য ব্রডব্যান্ড পরিষেবার তুলনায় এটি বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
বহু স্যাটেলাইটের প্রভাব : হাজার হাজার স্টারলিংক স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে মহাকাশ আবর্জনার (Space Debris) সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
বৈশ্বিক ইন্টারনেট শিল্পে পরিবর্তন আনছে স্টারলিংক?
বিশ্বের বড় ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো, যেমন- AT&T, Comcast, Verizon, Jio, BT স্টারলিংকের কারণে নতুন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ায় স্টারলিংক ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
কিছু দেশ এই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ, চীন ও রাশিয়া স্টারলিংকের বিকল্প তৈরির চেষ্টা করছে, যাতে তাদের নিজস্ব ইন্টারনেট অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
ইলন মাস্কের উচ্চাভিলাষী যত প্রকল্প
আরও পড়ুন:
তাপমাত্রা যখন সর্বনিম্ন!
ইলন মাস্কের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর মধ্যে স্টারলিংক অন্যতম। এটি স্পেসএক্সের একটি উদ্যোগ, যার লক্ষ্য পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া। ২০১৫ সালে স্পেসএক্স স্টারলিংকের পরিকল্পনা প্রকাশ করে এবং ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম দুটি পরীক্ষামূলক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। এরপর ২০১৯ সালের মে মাসে প্রথম ৬০টি স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠানো হয়, যা স্টারলিংকের বাণিজ্যিক যাত্রার সূচনা করে। ইলন মাস্কের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর মধ্যে স্টারলিংক ছাড়াও আরও বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ রয়েছে, যা প্রযুক্তি, পরিবহন, মহাকাশ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ গঠনে ভূমিকা রাখছে। তার কিছু উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো-
স্পেসএক্স (SpaceX) : ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্পেসএক্স বাণিজ্যিক মহাকাশ ভ্রমণ এবং মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছে। তাদের ফ্যালকন ৯, ফ্যালকন হেভি এবং স্টারশিপ রকেট পৃথিবীর বাইরে মানব বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে।
টেসলা (Tesla, Inc.) : টেসলা বৈদ্যুতিক যানবাহন (ঊঠ) বিপ্লবের পথিকৃৎ। ২০০৪ সালে ইলন মাস্ক এতে বিনিয়োগ করেন এবং পরে সিইও হন। টেসলার মডেল ৩, মডেল এস এবং সাইবারট্রাক বৈদ্যুতিক গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সাহায্য করছে।
নিউরালিংক (Neuralink) : ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত নিউরালিংক মানুষের মস্তিষ্ক ও কম্পিউটারের মধ্যে সংযোগ তৈরির জন্য কাজ করছে। এটি ব্রেন-মেশিন ইন্টারফেস (BMI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা স্নায়বিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করতে পারে।
দ্য বোরিং কোম্পানি (The Boring Company) : শহরের যানজট কমানোর লক্ষ্যে ২০১৬ সালে গঠিত এই প্রতিষ্ঠান আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল নির্মাণ করছে। এর মাধ্যমে দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন লাস ভেগাস লুপ।
ওপেনএআই (OpenAI) এবং এক্সএআই (xAI) : ইলন মাস্ক ২০১৫ সালে OpenAI-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) গবেষণায় অন্যতম। ২০২৩ সালে তিনি xAI প্রতিষ্ঠা করেন, যা জেনারেটিভ এআই উন্নয়নের ওপর কাজ করছে এবং Grok AI নামে একটি চ্যাটবট তৈরি করেছে।
হাইপারলুপ (Hyperloop) : ভবিষ্যতের উচ্চগতির পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে হাইপারলুপ প্রস্তাব করেন ইলন মাস্ক। এটি কম বায়ুচাপযুক্ত টিউবের মাধ্যমে ১২০০ কিমি./ঘণ্টার বেশি গতিতে চলতে সক্ষম, যা শহরের মধ্যে যাতায়াতের সময় কমিয়ে আনতে পারে।
এসব প্রকল্প ইলন মাস্কের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে মানবজীবনকে বদলে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে।
ভবিষ্যতে স্টারলিংকের পরিকল্পনা
স্টারলিংক ক্রমাগত তার প্রযুক্তি উন্নত করছে। ভবিষ্যতে তারা আরও উন্নত স্যাটেলাইট ব্যবহার করবে, যা বেশি ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করতে পারবে। বিশ্বব্যাপী স্টারলিংকের ব্যবহার প্রসারিত হবে, যাতে আরও বেশি মানুষ সংযুক্ত হতে পারে। মোবাইল স্টারলিংক পরিষেবা আনবে, যা গাড়ি, ট্রেন ও বিমানের জন্য ইন্টারনেট দেবে। এ ছাড়া স্পেসএক্স ২০২৭ সালের মধ্যে ১২,০০০ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করছে এবং ভবিষ্যতে ৪২,০০০ স্যাটেলাইট নিক্ষেপের সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রকল্প সফল হলে এটি পুরো বিশ্বে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। তবে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ ও সরকারি বিধিনিষেধ স্টারলিংকের ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করতে পারে। স্টারলিংক নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিপ্লব আনছে। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যদি দাম কমে এবং প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এটি আরও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে।