পরিযায়ী পাখিরগল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
পরিযায়ী পাখিরগল্প

শীতের আগমন সামনে রেখে দেশে আসতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখি বা অতিথি পাখি। আগামী কয়েক মাস রঙবেরঙের নাম না জানা অনেক রকম পাখিতে ভরে যাবে আমাদের জলাশয়, হাওর, বিল ও পুকুর। বড় বিচিত্র এসব পাখির বাচ্চা পালন, বাসা তৈরির কৌশল। ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাতসহ প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে তারা পাড়ি জমায় হাজারো মাইল দূরে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন -শামস্ বিশ্বাস

পাখি পরিযান

নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির প্রতিবছর বা কয়েক বছর পর পর একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে কিংবা সময়ে কম করে দুটি অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়াকেই পাখি পরিযান বলে। জীবজন্তুর ক্ষেত্রে ‘মাইগ্রেশন’-এর সঠিক পরিভাষা হচ্ছে সাংবাৎসরিক পরিযান। যেসব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয়, সেগুলোকে পরিযায়ী পাখি বলে। এসব পাখি প্রায় প্রতিবছর পৃথিবীর কোনো এক বা একাধিক দেশ কিংবা অঞ্চল থেকে বিশ্বের অন্য কোনো অঞ্চলে চলে যায় কোনো একটি বিশেষ ঋতুতে। ওই ঋতু শেষে সেগুলো আবার ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছিল, সেখানে। এমন আসা-যাওয়া কখনো এক বছরে সীমিত থাকে না। এ ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতিবছর এবং কমবেশি একই সময়ে।

কিছু প্রজাতির মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, এমনকি পোকামাকড়ও প্রতিবছর পরিযান ঘটায়। তবে পাখির মতো এত ব্যাপক আর বিস্তৃতভাবে কেউই পরিযানে অংশ নেয় না। পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১ হাজার ৮৫৫ প্রজাতিই (প্রায় ১৯ শতাংশ) পরিযায়ী।

পরিযানের কারণ

পাখি পরিযানের অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে খাদ্যের সহজলভ্যতা আর বংশবৃদ্ধি। উত্তর গোলার্ধের অধিকাংশ পরিযায়ী পাখি বসন্তকালে উত্তরে আসে অত্যধিক পোকামাকড় আর নতুন জন্ম নেওয়া উদ্ভিদ ও উদ্ভিদাংশ খাওয়ার লোভে। এ সময় খাদ্যের প্রাচুর্যের কারণে এগুলো বাসা করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। শীতকালে বা অন্য যে কোনো সময়ে খাবারের অভাব দেখা দিলে এগুলো দক্ষিণে রওনা হয়।

আবহাওয়াকে পাখি পরিযানের অন্য আরেকটি কারণ হিসেবে ধরা হয়। শীতের প্রকোপে অনেক পাখিই পরিযায়ী হয়। হামিংবার্ডও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে খাবারের প্রাচুর্য থাকলে প্রচণ্ড শীতেও এগুলো বাসস্থান ছেড়ে নড়ে না। আলোর তীব্রতাও এগুলোর পরিযানের অন্যতম কারণ।

প্রক্রিয়া

দীর্ঘ যাত্রায় পাখি কীভাবে পথ চেনে, এ এক রহস্য। দেখা গেছে, পথ চেনায় অভিজ্ঞ পাখিগুলোই ঝাঁকের সামনের দিকে থাকে। নতুনরা থাকে পেছনে। এ ক্ষেত্রে পাখিগুলো উপকূলরেখা, পাহাড় শ্রেণি, নদী, সূর্য, চাঁদ, তারা ইত্যাদির মাধ্যমেই পথ খুঁজে নেয় বলে ধারণা করা হয়। যেসব পাখি একা ভ্রমণ করে, এগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে- জীবনে প্রথমবার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেও গন্তব্যে পৌঁছে যায়। এ জন্য বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রই পাখির পথ চেনায়।

রোগের বিস্তার

পরিযায়ী পাখিগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিপজ্জনক রোগের জীবাণু বহন করার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এসব পাখি বহু বছর ধরে নির্দিষ্ট কিছু জীবাণু বহন করে বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে এগুলো অনেকটা ওই জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে এবং অন্যত্র জীবাণু ছড়িয়ে দেয়। প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন কোনো প্রজাতি পরিযায়ী প্রজাতির সংস্পর্শে এলে সঙ্গে সঙ্গেই আক্রান্ত হয়। পশ্চিম নীল ভাইরাস ও এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (যার জন্য বার্ড ফ্লু রোগ হয়) এমনই দুটি জীবাণু। সিট্টাকোসিস পরিযায়ী পাখিবাহিত একটি রোগ।

বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি

মূলত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে থেকেই পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসা শুরু করে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় মার্চের শেষ নাগাদ থাকার পর আবার ফিরে যায় পাখিগুলো। এক সময় ধারণা ছিল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিগুলো এ দেশে আসে। কিন্তু এখন এর ভিন্নমত পাওয়া যাচ্ছে।

পরিযায়ী পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, পাখিগুলো মূলত আসে উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের একটি অংশ, চীনের কিছু অঞ্চল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ উত্তর মেরু, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু এলাকা এবং হিমালয় পর্বতমালার আশপাশের এলাকা থেকেই পাখিগুলো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এ অঞ্চলে আসেÑ যেখানে তুলনামূলক কম ঠাণ্ডা পড়ে ও খাবার পাওয়া যায়। আবার মার্চের শেষ দিকে যখন এ অঞ্চলে গরম পড়তে শুরু করে ও শীতপ্রধান এলাকায় বরফ গলা শুরু হয়, তখন আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাখিগুলো নিজ এলাকায় ফেরত চলে যায়।

বাংলাদেশে ১৯৯৪ সালে অতিথি পাখি এসেছিল ৮ লাখের বেশি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে দুই লাখের নিচে। অর্থাৎ গত ২০ বছরে প্রায় ছয় লাখ পাখি আসা কমে গেছে। তবে এখন ধারণ করা এই সময় এ সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো। এ সংখ্যা প্রতিবছরই হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাপক হারে পাখি শিকার ও জলাভূমির সংখ্যা কমে যাওয়াই এর কারণ।

প্রকার

পাখির মধ্যে সাধারণত তিন ধরনের পরিযান দেখা যায়। পরিযানের প্রকারগুলো হলো-

স্বল্পদৈর্ঘ্য পরিযান : এ ধরনের পরিযায়ী পাখিগুলো প্রধানত স্থায়ী। তবে খাদ্যাভাব দেখা দিলে এগুলো তাদের স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্রের আশপাশে অন্য অঞ্চলে গমন করে। এগুলোর পরিযান অনিয়মিত। চাতক, পাপিয়া, খয়েরিডানা পাপিয়া স্বল্পদৈর্ঘ্যরে পরিযায়ী পাখি।

মধ্যদৈর্ঘ্য পরিযান : এ প্রজাতির পাখি প্রায়ই পরিযান ঘটায়। তবে পরিযানের বিস্তার স্বল্পদৈর্ঘ্যরে পরিযায়ী পাখির তুলনায় অনেক বেশি হয়।

দীর্ঘদৈর্ঘ্য পরিযান : এ প্রজাতির পাখির পরিযান এক বিশাল এলাকাজুড়ে ঘটে। এ ধরনের পাখির এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে এক বা একাধিক সপ্তাহ লাগে। এ সময় এগুলো হাজারো মাইল দূরত্ব পাড়ি দেয়। নীল শির, লাল শির, কালো হাঁস, লেনজা হাঁস, ক্ষুদে গাঙচিল দীর্ঘদৈর্ঘ্যরে পরিযায়ী পাখি।

কোথায় দেখা মিলবে

শীতের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় জলাশয়ে দেখা মেলে এসব নানা রঙবেরঙের পরিযায়ী পাখির। ঢাকার কাছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়ে এসব পাখি দেখতে ভিড়ও করেন অনেক দর্শনার্থী। এ ছাড়া মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক, বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও নিঝুম দ্বীপ, ঢালচর, চরকুকরী-মুকরী কিংবা দুবলারচরেও এসব পাখির ঝাঁক দেখা যায় শীতের সময়।

বিভ্রান্তিমূলক নাম

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও বই-পুস্তকে অনেকে পরিযায়ী পাখির অজ্ঞতাবশত অতিথি পাখি, গেস্ট বার্ড, ভিনদেশি পাখি বা বিদেশি পাখি হিসেবে অভিহিত করেন। আবার বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি বললেই ধরে নেওয়া হয় কেবল শীতকালে আসা হাঁস আর রাজহাঁসকে। এ হিসেবে কালেম, ডাহুক বা পাতি সরালিকেও শীতের পাখি হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে এগুলো বাংলাদেশের নির্ভেজাল স্থানীয় বাসিন্দা প্রজাতির পাখি। পরিযায়ী পাখি মাত্রই যে হাঁসজাতীয় ও জলচর পাখিÑ এমনটি নয়। পরিযায়ী পাখির এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে খঞ্জনা, চটক, মাঠ চড়ুই, কসাই পাখি, গাঙচিল, বিভিন্ন শিকারি পাখি ইত্যাদি। তা ছাড়া পরিযায়ী পাখি বসন্তে বা শরৎকালেও আসতে-যেতে পারে।