ঈদে বেতন-বোনাস নিয়ে সংকটে পোশাক খাত
প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। যথারীতি বেতন-বোনাসের দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। কোথাও কোথাও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা না পেলে বড় কারখানায় বেতন-বোনাস নিয়ে সমস্যা না হলেও ছোট ও মাঝারি কারখানায় সমস্যা রয়েই যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছেÑ শ্রমিকের বেতন-বোনাস দেওয়ার জন্য মালিকদের কোনো আর্থিক সহায়তা দেবে না সরকার। তবে শ্রমিক অসন্তোষে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বা অস্থিরতা হলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
অন্যদিকে মালিকদের কষ্ট যতই হোক না কেন, শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, সরকারের কাছে রপ্তানিমুখী শিল্পের নগদ সহায়তার ৭ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। সরকার এ পর্যন্ত ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। সরকার আর দিতে পারবে না। এই টাকা দিয়েই শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে হবে।
এদিকে গণমাধ্যমকে অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, শ্রমিকের বেতন-বোনাস দেওয়ার জন্য মালিকদের কোনো আর্থিক সহায়তা দেবে না সরকার। তবে শ্রমিক অসন্তোষে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বা অস্থিরতা হলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে শ্রমিকদের দাবি ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের বিষয়কে অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন তৈরি পোশাক খাতের মালিকরা। একই সঙ্গে ব্যাংক থেকে অর্থ না পাওয়ার কারণে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে পারছে না বলেও অভিযোগ তুলেছেন।
তারা বলছেন, ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না বলে বেতন-বোনাস দিতে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকার তাদের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে কোনো প্রকার সহযোগিতা করছে না।
এদিকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাত সরকারের কাছ থেকে যে খুব বেশি সহায়তা পেয়েছে তা নয়। বিগত দিনেও তেমন কোনো সহায়তা পোশাক খাত পায়নি। সমস্যার সমাধান মালিকদেরই করতে হয়েছে। এবারের সমস্যাও মালিকদেরই মেটাতে হবে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিশে^র অন্যান্য দেশ যেভাবে রপ্তানি খাতে সহায়তা করে, সেভাবে বাংলাদেশ সরকার নজর দেয়নি। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করাটাই উদ্যোক্তাদের অপরাধ হয়েছে।
অন্যদিকে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা আছে। আশা করা যায় সংকট কেটে যাবে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
এদিকে শ্রমিকরা এবার বেতন-বোনাসের পাশাপাশি ঈদের ছুটি বৃদ্ধির দাবিও জানাচ্ছেন। এসব দাবি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই তারা রাস্তা অবরোধ, বিক্ষোভ করছেন। এ ছাড়াও মার্চ মাসের পুরো বেতনের দাবি নিয়েও রাস্তায় নেমেছেন শ্রমিকরা। তাদের বেশ কিছু অযৌক্তিক দাবি রয়েছে। এসব দাবি নিয়ে রাস্তায় নামার কোনো প্রয়োজন নেই বলেও মনে করেন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ঈদের আগমুহূর্তে এসব দাবি নিয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামা ঠিক না। আর কোনো দাবি থাকলে সেটা মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা সম্ভব।
এদিকে চলচ্চিত্র অভিনেতা ও গার্মেন্টস মালিক অনন্ত জলিলের মালিকানাধীন সাভারের হেমায়েতপুরের এজেআই ও এবি গ্রুপেও সম্প্রতি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে গত বুধবার অনন্ত জলিল এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রমিক সংগঠন ও মালিকদের সংগঠনের একাংশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন।
তিনি বলেছেন, লাগাতার শ্রমিক অসন্তোষের জন্য শ্রমিক সংগঠন এবং বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর একাংশ দায়ী।
তিনি বলেন, বিজিএমইএতে দুই শতাংশ লোক আছে, যারা এই শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে মিশে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে, দলাদলির চেষ্টা করে। গার্মেন্টস কোনো রাজনীতির বস্তু না। এটা ইন্ডাস্ট্রি, এটা কোনো রাজনীতির খেলার মাঠ না।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, পোশাক কারখানাসংশ্লিষ্ট ২৪০টি গ্রুপ অব কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ায় দেশে ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বেড়ে গেছে।
যদিও তার এই কোম্পানি বন্ধের দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রেস সচিব লিখেছেন, গত সাত মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই সপ্তাহে গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারের প্রায় ৯৯ শতাংশ কারখানা খোলা ছিল।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
এদিকে শ্রমিকনেতারা বলছেন, এই মুহূর্তে শিল্পকারখানায় তাদের চারটি দাবি না মানায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত ছুটি বাড়ানো, আরেকটি হলো ঈদ বোনাস। এর সঙ্গে চলতি মাসের অগ্রিম বেতন এবং বকেয়া বেতন চাইছেন তারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আক্তার বলেন, এখন শ্রমিক অসন্তোষ চলছে ঈদের ছুটি নিয়ে। কারণ ঈদের ছুটি কতদিন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর শ্রম আইনেও উৎসব ছুটি কম। কোনো কোনো কারখানায় ঈদ বোনাসসংক্রান্ত ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু এর চেয়ে বড় সমস্যা হলো, গত পাঁচই আগস্টের পর বেশ কিছু বড় কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সব কারখানার শ্রমিকদের পাওনা নিয়েই গণ্ডগোল হচ্ছে।
তার মতে, প্রত্যেকটা কোম্পানিকেই ঈদের সময় আগের ও চলতি মাসের বেতন এবং বোনাস দিতে হয়। এ নিয়ম নিয়ে কারখানাগুলোয় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মালিকপক্ষ ও সরকার শ্রমিকদের দাবিকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় এই অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।
বাবুল আক্তার বলেন, তারা যদি শুরু থেকেই শ্রমিকদের দাবিদাওয়াকে গুরুত্ব দেয়, তা হলে এই ধরনের পরিস্থিতি হয় না। শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে মালিক ও সরকারের আগ্রহ কম।
কারখানাগুলোতে কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন নেই, সেটিও অস্থিরতার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, সব ঈদে তিনটা বেতন-বোনাস একসাথে পড়ে না। এবার গত মাসের বেতন দিতে হয়েছে। ঈদের বোনাস এবং রানিং মাসের অগ্রিমও দিতে হচ্ছে। তাই চাপ বেশি পড়ছে।
তিনিও ব্যাংকের ওপর দায় চাপিয়ে বলেন, ব্যাংকিং খাত এখন অস্থিরতার মাঝে আছে। কারখানাগুলো ব্যাংকের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। মালিকরা সাধারণত টাকা ম্যানেজ না করতে পারলে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। কিন্তু ব্যাংক এখন সহজে ঋণ দেয় না।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
মালিকরা ব্যাংক থেকে অর্থ জোগাড় করতে না পারলে অ্যাসোসিয়েশনের কাছে সাহায্য চায়, এ কথা জানিয়ে মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, প্রতিবছরই ঈদের আগে এই শ্রমিক অসন্তোষ আমরা দেখি, এটি সত্যি। কিন্তু এই দেখাটা ঈদের আগে শেষ হয়ে যায়, এটাও সত্যি। বাংলাদেশে বর্তমানে তিন হাজার পোশাক কারখানা আছে। এসব কারখানার বেশিরভাগই কিছুটা দেরিতে হলেও ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিয়ে দেয়। যারা একটু টানাপোড়েনের মাঝে থাকে, মানে যারা ফিন্যান্সিয়ালি স্ট্রং না, তারা সময়মতো দিতে পারে না।
রুবেল বলেন, বাংলাদেশে অনেকগুলো ব্যাংক ছিল। কিন্তু সেগুলোর প্রায় ১০টা দেউলিয়া হয়ে গেছে। সেখানে তিন হাজার গার্মেন্টসের ৫০-১০০টায় সমস্যা হতে পারে না? এটা মেনে নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। এসব কারখানার সংকট উত্তরণে সরকারের পক্ষ থেকেও ভূমিকা নিতে হবে।