কোম্পানির টাকা লুটপাট বন্ধে উদ্যোগী সরকার

লুৎফর রহমান কাকন
১৯ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কোম্পানির টাকা লুটপাট বন্ধে উদ্যোগী সরকার

জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ এবং বিভিন্নভাবে সরকারি অর্থের হরহামেশা অপব্যবহার রোধ করতে এ খাতের বোর্ড ও কোম্পানিগুলোর লাগাম টেনে ধরেছে জ¦ালানি বিভাগ। জ¦ালানি বিভাগ মনে করছে, কোম্পানিগুলোর পরিচালনা বোর্ডের সদস্য, কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানান উপায়ে রাষ্ট্রের টাকা নিজেদের পকেটস্থ করার পন্থা বের করে নিয়েছেন। বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের মধ্যে দেদারসে টাকার ভাগ-বাটোয়ারা করছেন। তারা কোম্পানির এজিএম, উৎস বোনাস, প্রফিট বোনাস, গাড়ির ঋণ, হাউসবিল্ডিং ঋণসহ নানা উপায়ে রাষ্ট্রের টাকা লুটে নিচ্ছেন সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি জ¦ালানি বিভাগ থেকে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলোতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে- এখন থেকে কোম্পানিগুলোর যে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। শুধু বোর্ডের অনুমোদন নিয়েই আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা যাবে না।

বিদেশ থেকে উচ্চ দামে এলএনজি আমদানি করে সরকার ভর্তুকি মূল্যে কোম্পানিগুলোকে গ্যাস দেয়। অথচ সেই গ্যাস বিভিন্ন কারখানায় উচ্চমূল্যে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা ‘প্রফিট বোনাস’ নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বছরে প্রতিটি কর্মকর্তা কর্মচারীর মাথাপিছু ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস গ্রহণের উদাহরণও রয়েছে। সরকার যেখানে বেশি দামে এলএনজি কিনে ভর্তুকি মূল্যে পাইপলাইনে সরবরাহ করছে, সেখানে এসব কোম্পানি কী করে প্রফিট দেখিয়ে এত মোটা অংকের বোনাস গ্রহণ করছে- এমন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই নড়েচড়ে বসেছে সরকার; উদ্যোগী হয়েছে বোনাসের নামে লুটপাট বন্ধের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ¦ালানি বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আমি লক্ষ্য করে দেখেছি- জ¦ালানি বিভাগের আওতাধীন কোম্পানি বোর্ড সদস্য হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তার অনেক বেশি উৎসাহ রয়েছে। এর কারণ, এতে করে চাকরির বাইরেও নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নেওয়া যায়। তিনি বলেন, বোর্ডের সদস্যরা প্রতিটি সভায় উপস্থিত থাকার জন্য আর্থিক সম্মানী পান; এজিএমসহ যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বৈঠক-কর্মকা-েও তারা সম্মানী পান। তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কোম্পানির গাড়ি ব্যবহার করেন। কোম্পানির

চাকরি প্রমোশন, বদলি নিয়োগ সব ক্ষেত্রে বোর্ড প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ফলে কোম্পানির বোর্ডে থাকতে তাদের আগ্রহ প্রবল। এই কর্মকর্তা বলেন, শুধু তাই নয়, কেবল বোর্ডের অনুমোদন নিয়েই কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। আমি মনে করি, এভাবে রাষ্ট্রের টাকার যাচ্ছেতাই অপব্যবহার হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা থাকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে নানা উপায়ে কোম্পানিগুলোর টাকা মূলত লুটপাট করা হচ্ছে। অথচ প্রতিটি কর্মচারী চাকরির জন্য নিয়মিত বেতন তো পাচ্ছেন।

সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী, পেট্রোবাংলা ও বিপিসিসহ (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কোম্পানির কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য ঋণ পেতেন। তবে এ ঋণ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। সূত্র মতে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জ¦ালানি বিভাগের প্রশাসন শাখা-৩ থেকে উপসচিব মো. আহসান উদ্দিন মুরাদ একটি চিঠি ইস্যু করেন। এতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত পেট্রোবাংলা, বিপিসি এবং তাদের আওতাধীন সব কোম্পানির কর্মকর্তাদের সব ধরনের গাড়ি কেনার ঋণ ও গাড়িসেবা নগদায়ন যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে স্থগিত করা হলো।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন কোম্পানিসমূহের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) পরিচালকগণকে বড় অংকের আর্থিক সম্মানী প্রদান করা হয়। পরিচালনা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে এ ধরনের সম্মানী প্রদান করা হলেও এটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে বোর্ড সদস্যরা নিজেরাই নিজেদের সম্মানী নির্ধারণ করেন বিধায় এটা সুস্পষ্ট স্বার্থের সংঘাত। তাই কোম্পানির এজিএমে পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকসহ কাউকেই নিয়মিত সভায় অংশগ্রহণের জন্য নির্ধারিত সভার সম্মানীর বাইরে অন্য কোনো সম্মানী প্রদান না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে পৃথক আরেক চিঠিতে বলা হয়েছে- এখন থেকে কোম্পানির কর্মচারীদের সুবিধা বাড়াতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জ্বালানি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এবং পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কোম্পানিগুলোর জন্য এমন শর্তারোপ করে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জ¦ালানি বিভাগের আরেক নির্দেশনায় কোম্পানির বোর্ড কমিটিরও লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। কোম্পানিসমূহের পরিচালনা পর্ষদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে অনুসরণীয় নির্দেশনায় বলা হয়েছে- কোনো বিষয়ে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও সদস্যদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। জটিল সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সেগুলো সংশ্লিষ্ট বোর্ড কমিটির মতামতের জন্য প্রেরণ করতে হবে। বোর্ড কমিটি প্রয়োজনে একাধিক কারিগরি কমিটি গঠন করবে। সেই সব কমিটির মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

উল্লেখ্য, জ¦ালানি বিভাগ থেকে জারিকৃত একাধিক নির্দেশনায় দেখা গেছে, জ¦ালানি বিভাগের আওতাধীন কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যমান অনেক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারের এ নির্দেশনায় কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এক সময় তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বছরে ১০টি বোনাস পেতেন। এখন একটাও পাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে যে কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের এমন কঠোর নির্দেশনা সত্যিই হতাশাজনক। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী গাড়ির ঋণ এতদিন সবাই পেয়ে আসছিলেন। এখন সেটা বন্ধ করে দিলে কর্মীদের হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক।

এ কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি বিভাগ একই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হলে কেন শুধু জ¦ালানিতেই এমন করা হচ্ছে সেটা বোধগম্য নয়। আরেক কর্মকর্তা বলেন, বোর্ড সদস্যরা নানা অনৈতিক সুবিধা নেন, এটা সত্য। তিনি বলেন, এমনও দেখা গেছে বোর্ডের কোনো সদস্যের পরিবারের কেউ ঘুরতে যাবেন, সেজন্য কোম্পানি থেকে গাড়ি, জ¦ালানি তেল, এমনকি প্রয়োজনীয় খাবার-দাবারও কিনে দিতে হচ্ছে। যেহেতু বোর্ডের সদস্যরা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, তাই কোম্পানির পক্ষে এতে ‘না’ করার সুযোগ নেই। সেগুলো বন্ধ করা, অর্থ ব্যয়ে নজরদারি রাখাটা যথার্থ সিদ্ধান্ত বলে তিনি মনে করেন। তবে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যায্য আর্থিক সুবিধা যেন বন্ধ না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান তিনি।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উভয় খাতে উৎপাদন, উত্তোলন, সঞ্চালন, বিতরণ খাতে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে সরকার। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ধেক এবং সঞ্চালন ও বিতরণের পুরোটাই রয়েছে সরকারের হাতে। অন্যদিকে, গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের আংশিক রয়েছে সরকারের হাতে। তবে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ করে সরকারি কোম্পানি। এর বাইরে এখন এলএনজি আমদানি ও সরবরাহ করে থাকে সরকারি কোম্পানি। সরকার উৎপাদন পর্যায়ে ভতুর্কি দিলেও বিতরণ ও সঞ্চালনে কোনো ভর্তুকি নেই। ফলে প্রত্যেকটি কোম্পানি বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী এসব মুনাফা বণ্টন করা হচ্ছে। এতে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বছরে বেতন-ভাতার চাইতে বেশি অর্থ প্রফিট বোনাস হিসেবে পাচ্ছেন। প্রফিট বোনাস বণ্টনে একেবারে নিচু স্তরের কর্মী যা পান প্রতিষ্ঠান প্রধানও ঠিক তাই পান। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এর সূত্রপাত হয় মূলত কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির প্রফিট বোনাস নিয়ে। দেখা গেছে, সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস কিনে সেটা সার কোম্পানির কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে বছরে প্রতিটি কর্মকর্তা কর্মচারী ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিস বোনাস গ্রহণ করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার যেখানে বেশি দামে এলএনজি কিনে ভর্তুকি মূল্যে পাইপলাইনে সরবরাহ করছে, সেখানে এসব কোম্পানি কি করে প্রফিট দেখিয়ে বোনাস গ্রহণ করছে?

এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে- পেট্রোবাংলা-বিপিসির আওতাধীন কোনো কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য বিদ্যমান, নতুন যে কোনো প্রকৃতির আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকলে, তা পেট্রোবাংলা-বিপিসির মাধ্যমে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত ৫ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন উপসচিব থেকে তার ওপরের স্তরের কর্মকর্তাদের জন্য সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করে। ওই দিন প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশন এই সুপারিশ জমা দেয়।

সরকারি চাকরিতে বেতন স্কেলের ওপর ভিত্তি করে কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য ঋণ পেয়ে আসছেন। একই সঙ্গে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও তারা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। জ্বালানি বিভাগের সব কোম্পানির মালিকানা সরকারের হাতে থাকায় একইভাবে কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা এই সুবিধা পেতেন। তবে এ আদেশের পর এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, উপসচিব পদে তিন বছর চাকরির পর কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনতে পারেন। গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার করে টাকাও পান তারা।

এদিকে জ¦ালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ বিপিসির আওতাধীন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএসওসিএল) পক্ষ থেকে জ¦ালানি বিভাগে চিঠি দিয়ে তিন অর্থবছরে কর্মকর্তাদের উৎসাহ বোনাস দেওয়ার আবেদন করেছেন। সেখানে তারা তিন অর্থ বছরে গড়ে ৬০ জন কর্মকর্তার মধ্যে প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রফিট বোনাস হিসাবে প্রদান করার আবেদন করেছেন। তবে একটি সূত্র বলছে, জ¦ালানি বিভাগ থেকে সেটা প্রদান না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।