ভূমি অফিস হাবিবুল্লাহর টাকার খনি

সোহেল রানা, রাজবাড়ী
১৪ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ভূমি অফিস হাবিবুল্লাহর টাকার খনি

রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কানুনগো পদে কর্মরত এসএম হাবিবুল্লাহর কাছে ভূমি অফিস যেন টাকার খনি। যখন যেখানে পদায়ন হয়েছে, টাকা কামিয়েছেন দুই হাতে। এর মধ্য দিয়ে নিজের এবং স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। এসব সম্পদের মূল্য শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। নিজে ও স্ত্রী-সন্তানরা চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে। তার পরিবার বসবাস করেন রাজধানীর বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। চাকরির সুবাদে নিজের ও স্বজনদের নামে রাজধানী ঢাকা, নিজ জেলা রাজবাড়ী ও গাজীপুর, কক্সবাজর, কুয়াকাটা বিভিন্ন জায়গায় জমি, প্লট, ফ্ল্যাটসহ অঢেল সম্পদ গড়েছেন। তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে কয়েক দফা লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে পার পেয়ে যান তিনি।

এসএম হাবিবুল্লাহর বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামে। তিনি গ্রামের মৃত আলহাজ¦ ছালামত আলী শেখের ছেলে। ১৯৮৩ সালে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৮৯ সালে সহকারী তহশিলদার হিসেবে রাজবাড়ী কালেকটরেটে চাকরিতে যোগদান করেন। পরে তহশিলদার এবং এরপর কানুনগো পদে পদোন্নতি পান। সংশ্লিষ্টরা বলেন, জমি কেনা হাবিবুল্লাহর নেশা।

সর্বশেষ গত ১০ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর দুদকের ঢাকা কার্যালয়ে মো. জিল্লুল রহমান নামের এক ব্যক্তি এসএম হাবিবুল্লার দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য লিখিতভাবে একটি অভিযোগ জমা দেন। এর একটি কপি এই প্রতিনিধির হাতে এসেছে। এতে বলা হয়, রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কানুনগো পদে কর্মরত হাবিবুল্লাহ জ্ঞাত আয়বর্হিভূতভাবে শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।

লিখিত অভিযোগের সূত্র ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসএম হাবিবুল্লাহর স্ত্রী সাহিদার নামে ঢাকা ১৫৯/১১ বিএল মনিপুরে ৭৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা মূল্যের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং উত্তরা হাউজিং সোসাইটিতে আরও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তার পরিবার ঢাকায় থাকে। ঢাকায় পরিবারের সদস্যদের চলাচলের জন্য ঢাকা মেট্রো গ-৩৪-৮১২৩ নম্বরের একটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। রংপুরে নিজের জন্য হাবিবুল্লাহর আরেকটি প্রাইভেট কার রয়েছে। তার ছেলের রয়েছে ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের জ-১৫ মোটরসাইকেল। তার স্ত্রী সাহিদা ও সন্তানের নামে রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। হাবিবুল্লাহর আয়কর রিটার্নের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার মোট সম্পদ ২২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩০ টাকা এবং মোট বেতন ভাতাসহ বার্ষিক আয় ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৯৬০ টাকা। এর মধ্যে ১০ হাজার ৫৮৬ টাকা আয়কর প্রদান করেন তিনি।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, এসএম হাবিবুল্লাহ এতটাই প্রভাবশালী যে, দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লেও অদৃশ্য কারণে তা গায়েব হয়ে যায়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কানুনগো পদে কর্মরত থাকায় ভূমি পরিদর্শন, খাসজমি বরাদ্দে মতামত, তদন্তসহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তিনি সব কাজ সম্পন্ন করে থাকেন বলে। ভূমি প্রতিবেদন ও খাসজমি বরাদ্দে তিনি নেন লাখ লাখ টাকা ঘুষ। তার ইচ্ছামতো প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে কথা বললে তিনি হেনস্তা করে থাকেন। অভিযোগ আছে, মূলত টাকা কামাইয়ের লক্ষ্যে তিনি রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চাকরি জীবনের বেশি সময় কাটিয়েছেন। অন্যত্র বদলি হলেও তিনি মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে পুনরায় ঢাকায় বদলি হন। বর্তমান কর্মস্থল রংপুর জেলা থেকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য তিনি জোর তদবির চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা সদর ও সদর ইউনিয়নের ৪৭নং মৌজার টেলিফোন একচেঞ্জ এলাকায় এবং বালিয়াকান্দি ভাই ভাই ফিলিং স্টেশন এলাকায় এসএম হাবিবুল্লাহর ও তার স্ত্রী সাহিদা সুলতানা এবং তাদের সন্তান হাসিবুল হাসান ও রাকিবুল হাসান, শালিকা হামিদা পারভীনের নামে রয়েছে বাড়ি করার মতো মূল্যবান ভিটাসহ কোটি টাকার জমি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হাবিবুল্লাহ স্থানীয় ব্যক্তি খন্দকার হাসান তারেকের কাছ থেকে ৬৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকার জমি ক্রয় করেন। এর মধ্যে ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নগদ ও গত ১২ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মিরপুর ব্রাঞ্চে নিজের ৪০১৬...৬৮৫৮ নং হিসাব থেকে ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকার চেক প্রদান করেন হাবিবুল্লাহ। হিসাবটিতে হাবিবুল্লাহর দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত কোটি কোটি টাকা জমা রয়েছে বলেও জানা গেছে।

হাবিবুল্লাহ এক সময় বালিয়াকান্দি বাজারের তালপট্টিতে ভাড়া বাসায় থাকলেও বর্তমান শহরে একতলা বিশিষ্ট ভবনসহ ১২ শতক জমির ওপর নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। এলাকায় নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের নামে বহরপুর ইউনিয়নের রায়পুর মৌজায় রয়েছে ১০ একর কৃষি জমি। বহরপুরের ইলিশকোল মৌজায় একটি মার্কেটের একাধিক পজিশন ছাড়াও আরও কৃষিজমি ক্রয় করেছেন। এ ছাড়া বালিয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ড এলাকা, বালিয়াকান্দি সরকারি কলেজ সংলগ্ন মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় তার কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ রয়েছে।

সূত্রমতে, দুর্নীতির অভিযোগ এড়াতে হাবিবুল্লাহ অধিকাংশ জমির নামজারি সম্পন্ন করেননি। দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, অনুসন্ধান করলে বালিয়াকান্দি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, বহরপুর ভূমি অফিস, বালিয়াকান্দি ভূমি অফিস থেকে তার ও তার স্ত্রী-সন্তানের সম্পত্তির যাবতীয় তথ্য পাওয়া সম্ভব।

বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের রায়পুর, ইলিশকোল, বালিয়াকান্দি সদর ও পাইককান্দি মৌজায় এক বছরেই ১৭টি দলিলে কয়েক একর ভিটা সম্পত্তি ক্রয় করেছেন নিজ, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে। তার বাড়িতে একটি বড় গরুর খামার রয়েছে, যাতে গরুর সংখ্যা ৩১টি। তার গরু ও ফার্মের আনুমানিক মূল্য ৬০ লাখ টাকা। তার ছেলে প্রতি বছরে ছয়-সাতবার মালয়েশিয়া যাতায়াত এবং দামি মোবাইল ফোন ব্যবহারসহ বিলাসী জীবনযাপন কনে। ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, কক্সবাজার এবং কুয়াকাটা এলাকায় ২০ কোটি টাকার প্লট আকারে সম্পদ রয়েছে হাবিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যদের নামে। স্থানীয় বালিয়াকান্দি থেকে শিমুল সেখ, মনিরুদ্দীন, আজিজ, মোতাহারদের কাছ থেকে ১ কোটি টাকার জমি ও নিজ গ্রামের বকু, অলি, মোতালেবের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার জমি ক্রয় করেছেন। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী হজ্ব করে এসেছেন ২০২৩ সালে, যেখানে ১৫ লাখ টাকা খরচ করেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম বলেন, হাবিবুল্লাহর নেশা জমি কেনা। কিন্তু তার আয়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ জমি কেনেন। যেখানে বিরোধ, সেখানেই জমি ক্রয় করেছেন। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনকে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় রংপুরে কর্মরত এসএম হাবিবুল্লাহর সঙ্গে। অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে স্থানীয় এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে নামে বেনামে অভিযোগ করে হয়রানি করছে। স্ত্রী ও ছেলের নামে জমি কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের আয়ের উৎস জানাতে পারেননি।

দুদকের ফরিদপুর জেলা কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, অভিযোগের বিষয়ে প্রধান কার্যালয় থেকে এখনও কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।