কাঁদিয়ে-জাগিয়ে চলে গেল আছিয়া

ধর্ষণের আট দিনের মাথায় সিএমএইচে মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, মাগুরা ও শ্রীপুর প্রতিনিধি
১৪ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কাঁদিয়ে-জাগিয়ে চলে গেল আছিয়া

মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে ফিরেছে আছিয়া। যে মেঠোপথে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরত, সেই একই পথে পাহাড়সম অভিমান নিয়ে ফিরেছে সে। তবে এবার আর চঞ্চল পায়ে মায়ের সঙ্গে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে ফেরেনি। ছোট্ট আছিয়া ফিরেছে সাদা কফিনে মোড়ানো লাশ হয়ে। যে উঠোনজুড়ে ছিল আছিয়ার পদচারণা, সেখানে কাঠের বাক্সে বন্দি ছিল আছিয়ার নিথর দেহ। গতকাল বৃহস্পতিবার এমন দৃশ্য দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেনি মানুষ। শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো গ্রামজুড়ে। এর আগে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ছোট শিশুটির ওপর নিষ্ঠুর পাশবিকতা কাঁদিয়েছে দেশের সব মানুষকে। ক্ষোভে ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ।

বোনের বাড়িতে পাশবিক উপায়ে ধর্ষণের শিকার হওয়া ১১ বছরের আছিয়া গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। দুপুর ১টার দিকে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন হাসপাতালটির পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক কর্নেল নাজমুল হামিদ। তিনি বলেন, সকালবেলা দুই দফায় শিশুটির ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ (আকস্মিকভাবে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া) হয়। সিপিআর দেওয়ার পর তার হৃৎস্পন্দন ফিরে এসেছিল। কিন্তু দুপুর ১২টায় তার আবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এই দফায় সিপিআর দেওয়ার পরও তার হৃৎস্পন্দন ফেরেনি। দুপুর ১টায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

জানা যায়, মৃত্যুর পর পবিত্র কালেমাযুক্ত একটি পতাকায় কফিন মুড়িয়ে আছিয়ার মৃতদেহ ঢাকার সিএমএইচ থেকে বের করা হয়। এরপর সামরিক হেলিকপ্টারে করে বিকালে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। শিশুটির মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর

বাড়িতে মাতম চলছে। খবর পেয়ে এলাকাবাসী ও আত্মীয়স্বজন শিশুটির বাড়িতে গিয়ে ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৮ মার্চ শিশুটিকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে। যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

গত ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় আছিয়াকে উদ্ধার করে মাগুরার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যান তার বোনের শাশুড়ি। তবে অবস্থা বেগতিক দেখে সেখান থেকে সরে পড়েন তিনি। পরে শিশুটির মা হাসপাতালে যান। সেদিন দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার রাতে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এরপর গত শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় শিশুটিকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (পিআইসিইউ) থেকে সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। তাকে ঢাকার সিএমএইচের পিআইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রেস উইং জানিয়েছে, মাগুরার শিশুর মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি এ মামলার আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন

মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার কথা জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়।

১ মার্চ মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে যায় শিশুটি। ৫ মার্চ দিবাগত রাতে ওই বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয় সে। ওই ঘটনায় ৮ মার্চ শিশুটির মা ধর্ষণের অভিযোগে মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় আছিয়ার বোনের শ্বশুর হিটু শেখ (৪৫), শাশুড়ি জাহিদা বেগম (৪০), স্বামী সজীব শেখ (১৯) ও ভাশুর রাতুল শেখকে (২৫) আসামি করা হয়েছে। তারা আগে থেকেই পুলিশের হেফাজতে ছিল। তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

এক সপ্তাহের মধ্যে বিচার শুরু : আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গতকাল জানিয়েছেন, আছিয়া ধর্ষণ মামলার বিচার আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হবে। তিনি বলেন, বিশেষ ব্যবস্থায় আজকেই (বৃহস্পতিবার) ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়া যাবে। সাত দিনের মধ্যে বিচারকাজ শুরু হবে। আসিফ নজরুল বলেন, অতীতেও ধর্ষণ মামলার বিচারকাজ সাত থেকে আট দিনের মধ্যে শেষ করার নজির রয়েছে। এবারও সাত দিনের মধ্যে বিচারকাজ শুরু করা সম্ভব হবে। এটি করতে পারলে বিচারক দ্রুততার সঙ্গে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবেন।

আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা নতুন একটি আইন করছি। আশা করা হচ্ছে রবিবার বা সোমবার নতুন আইন তৈরি করা হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনার বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে।

শোকে ছেয়ে গেছে সামাজিক মাধ্যম : আছিয়ার মৃত্যুর খবরে গোটা দেশ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিউজফিড ছেয়ে গেছে শোকের বার্তায়। আছিয়ার মৃত্যুর সংবাদে নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- আমাদের বোন আছিয়া আর নেই। আছিয়ার ধর্ষণের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্ষকদের শাস্তির এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক।

রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শোক ছুয়ে গেছে তারকাদের মন। অভিনেতা ইরফান সাজ্জাদ সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়ে লিখেছেন- আল্লাহ আপনি বিচার কইরেন। নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী লিখেছেন- ‘মরে আছিয়া বেঁচে গেল। আর বুঝিয়ে দিয়ে গেল অনেক কিছুই। আছিয়া, তীব্র কষ্ট পেয়েছ মা, এবার ঘুমাও। লজ্জিত, ক্ষমার অযোগ্য আমরা।

ঢাবিতে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের মশাল মিছিল : আছিয়ার মৃত্যুতে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাবিতে চার দফা দাবিতে মশাল মিছিল করেছে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ। মিছিল থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করা হয়। মিছিলকারীরা বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় কঠোর কোনো আইনি পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। বরং ধর্ষকের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে। আছিয়ার ধর্ষক ও খুনিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে।

বিচার চায় রাজনৈতিক দল : মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মাগুরার শিশুটি আমাদের লজ্জা দিয়ে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে। কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা তার মতো এক শিশুর ওপর দিয়ে গিয়েছিল। এই ‘নরপশুদের’ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। শোকবার্তায় জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আর কারও যেন আছিয়ার মতো করুণ পরিণতি না হয়, শিশুদের জন্য নিরাপদ হোক দেশ। মানুষ নামের যে পশুরা পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে গিয়ে নিষ্পাপ এ শিশুটির জীবনের আলো নিভিয়ে দিল আমি তাদের কঠিনতম ও সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের নেতারা বলেন, ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে আছিয়াদের মৃত্যু থামবে না। শোক প্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এক শোকবার্তায় বলেছে, আছিয়ার ওপর চলা নির্যাতন এবং তার মৃত্যু রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার জন্য চরম লজ্জাজনক। ফ্যাসিবাদী আমলে প্রতিষ্ঠিত বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে এর ধরনের ঘটনা ঘটেছে। জুলাই অভ্যুত্থানোত্তর নতুন বাংলাদেশে এর পুনরাবৃত্তি রোধে জোর দাবি জানায় এনসিপি।

দুই দফা জানাজা শেষে দাফন : মাগুরায় শিশু আছিয়ার প্রথম জানাজা গতকাল বৃহস্পতিবার মাগুরার নোমানী ময়দানে রাত ৭টা ১৫ মিনিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ অহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আমির মামুনুল হক, জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুলাহ, সারজিস আলম, জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাসহ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। পরে এশার নামাজ শেষে রাতে স্থানীয় সোনাইকুন্ডি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সোনাইকুন্ডী গ্রামের কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।

এর আগে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে শিশু আছিয়ার লাশ নিয়ে মাগুরা স্টেডিয়ামে নামে। লাশের সঙ্গে সরকারের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও আছিয়ার মা আয়েশা আকতার ছিলেন। মাগুরায় লাশ গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ অহিদুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার মাহমুদা মিনা। এ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, একটা মায়ের হাহাকার মানে সারা দেশের মায়ের হাহাকার। শিশুটি আমাদেরই মেয়ে। কাজেই এর বিচারের বিষয়টি আমরা সেভাবেই দেখছি।’

এর আগে ৫টার দিকে হেলিকপ্টারে করে মামুনুল হক, জাতীয় নাগরিক পার্টির হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম সেখানে পৌঁছান।

শোকাবহ পরিবেশ : মাগুরার শ্রীপুরে আলোচিত শিশু আছিয়ার ধর্ষণের আট দিনের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় মারা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে তার নিজ বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামে শুরু হয় শোকের মাতম। শোকের ছায়া নেমে পুরো এলাকাজুড়ে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ আছিয়ার ধর্ষণের আসামিদের ফাঁসি দাবি করেন। এ সময় আছিয়ার খালা রোকসানা বেগম, ফুফু মমতা বেগম, আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যসহ প্রতিবেশীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে হৃদয়বিদারক এক পরিস্থিতির অবতারণা হয়। শিশুটির এক আত্মীয় জানিয়েছেন, মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে ওর বাবা নির্বাক হয়ে গেছেন। সকাল থেকে কিছু খাননি। তাকে কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছে না। লোকজনের ভিড়ে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।

হিটু শেখের বাড়িতে আগুন : গতকাল সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে মাগুরা পৌর এলাকায় আসামি হিটু শেখের বাড়িতে প্রথমে ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ জানতা। পরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বাড়িতে আগুন জ্বলছিল।