অধিকার সমতা ক্ষমতায়ন উন্নয়ন

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৮ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অধিকার সমতা ক্ষমতায়ন উন্নয়ন

আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর লড়াই, অর্জন, অগ্রযাত্রার প্রতি সম্মান জানানো আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য- অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন/নারী ও কন্যা উন্নয়ন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যাশার কথা জানান কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী আমাদের সময়ের কাছে। তাদের কথাগুলো শুনেছেন শফিক রিয়ান ও তুহিন চাকমা

পাহাড়ি সমাজে নারীরা পুরুষের সমান গুরুত্ব পায় না

কুর্নিকোভা চাকমা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোটি কোটি নারীকে ছাপিয়ে যে নারীরা আজও পৃথিবীর ইতিহাসে প্রজ্বলিত হয়ে আছেন তারা কেমন ছিলেন? সমাজের বেড়াজাল কি তাদের স্পর্শ করেনি? আটক করতে চায়নি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশকে? সবার পরিচিত বেগম রোকেয়ার জীবনকেই দেখি না, কট্টর মুসলিম পরিবারের ছোট্ট মেয়েটি সেই বন্দিশালা থেকেই কী বিরাট স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছে! অন্য সবার মতো তিনিও জন্মের পর থেকেই রান্না রান্না খেলা এবং বাকি জীবনটা স্বামীর সেবায় মগ্ন থেকে স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। সবার থেকে লুকিয়ে কুপি জ্বালিয়ে পড়ার পরিবর্তে রাত্রিবেলার সুখনিদ্রা উপভোগ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি শিকল ভাঙার পথই বেছে নিয়েছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও অবিরাম স্বপ্ন বুনে গেছেন। তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি পর্যবেক্ষণ করেই তার বড় ভাই ও স্বামী দুজনেই তাকে চরমভাবে সহযোগিতা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, আমরা নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা, অন্য কেউ নয়। পাহাড়ি সমাজেও এখনও নারীরা পুরুষের সমান গুরুত্ব পায় না। অথচ আমাদের পাহাড়ি নারীরা পুরুষদের মতোই পাহাড়ে জুম চাষ কিংবা কৃষিকাজ, যেটাই হোক না কেন পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশেই পিছিয়ে থাকে না। কিন্তু তার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তাদের পরিশ্রমের প্রাপ্য মূল্যায়নটুকু পায় না। এ জন্য আমাদের নিজেদের ভেতরে স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। আমাদের নিজেদের ভেতরের সত্তাকে ‘নারী’ হিসেবে নয় একজন ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবেই নারীরা সামাজিক সব বাধা পেরিয়ে সুন্দর আগামী গড়ে তুলতে পারবে।

নারীরা চিরকালই সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ

নিশাত জাহান নীলা, শিক্ষার্থী, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নারী- স্রষ্টার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। কখনও কবির কবিতা-কাব্যের নায়িকা, কখনও সংগ্রামের অদম্য যোদ্ধা। মা, বোন, কন্যা কিংবা সহধর্মিণী প্রতিটি পরিচয়েই নারী মহিমান্বিত। নারী শুধু স্নেহ ও ভালোবাসার প্রতিমূর্তি নন, তিনি শক্তি, সাহস ও সংগ্রামেরও প্রতীক। যুগে যুগে নারীরা সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত হয়েছেন। নারীরা চিরকালই সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে নারীরাও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশ করতেই এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ৮ মার্চকে নারী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিশ্বের মানুষ। ১৯০৮ সালে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, বেতন বৃদ্ধি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় ১৫,০০০ নারীর নিউইয়র্ক শহরে আন্দোলনের মাঝেই লুকিয়ে ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে নারী দিবস পালনের ঐকান্তিক বাসনা।

প্রথমত, নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের অবসান চাই।

দ্বিতীয়ত, নারীর শিক্ষা ও স্বাবলম্বিতা নিশ্চিত করতে হবে।

তৃতীয়ত, কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ ও সম্মান চাই। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই সবার কাম্য হওয়া উচিত। কেবল নারী বলে নয়, একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে তাকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করা উচিত।

নারী দিবস এক দিনের আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে প্রতিদিনের চেতনা হয়ে উঠুক বিশ্বসমাজে। আমার প্রত্যাশা, একদিন এমন সমাজ হবে, যেখানে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদায় বসবাস করবে, যেখানে কোনো নারী তার অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করতে বাধ্য হবে না। সত্যিকারের নারী দিবস তখনই সফল হবে, যখন সমাজে আর কোনো নারী নির্যাতিত হবে না, অবহেলিত হবে না, আর কোনো মেয়েকে তার স্বপ্ন।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষের সমতুল্য

মেহনাজ শাহরিন অর্থি, শিক্ষার্থী, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের সমাজে মেয়েদের সঙ্গে বাইরে এক রকম আচরণ আর ঘরে আরেক রকম আচরণ করা হয়। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এক রকমের নারীবিদ্বেষী মনোভাব বিরাজ করে। ‘নারীবাদী’ শব্দটিকে মানুষ গালি মনে করে। কারণ তারা নারীবাদ বিষয়টি নিয়ে ভুল জানে। বর্তমানে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে নারীদের পদচারণা নেই। অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবখানেই তো নারীদের হাতের ছোঁয়া বিরাজমান। দেশ চালানোর মতো কঠিন কাজেও তারা পিছিয়ে নেই। শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষের সমতুল্য বলা চলে। এগুলো মূলত তাদের চেষ্টার ফল। খারাপ লাগার বিষয়টি এই যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে এখনও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে হয়। এখনও অনেক জায়গায় নারী-পুরুষের ভেদাভেদ করে দেখা হয়, যেটা কারোই কাম্য নয়। একটি দেশের উন্নয়নেও এটি বাধা। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কথাটার মর্ম সবাই বোঝে না। এমনকি নারীরাও বিষয়টি বোঝে না। একটি পরিবারে দেখা যায়, একজন মা তার মেয়ে সন্তানের চেয়ে ছেলে সন্তানকে সর্বক্ষেত্রে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এতেই বোঝা যায়, নারীরাও নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা। একজন নারী কখনও মা, কখনও বোন, কখনও স্ত্রী, কখনও বা সন্তান। সংসার যে রমণীর গুণে সুখী হচ্ছে, তাকে পায়ে নয়, মাথায় তুলে রাখা উচিত। একটি শিশুর প্রধান শিক্ষক তার মা। নেপোলিয়নের কথায়, আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব। এখনও আমাদের দেশে নারীদের ঘরবন্দি করে রাখা হয়, শিক্ষার আলো দেখানো হয় না। নারীরা আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক। দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় এটা যেমন পুরুষদের বুঝতে হবে তেমনি স্বয়ং একজন নারীকেও বুঝতে হবে।

নারী উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সমাজের অগ্রগতি এগিয়ে চলে

সাবরিনা আক্তার সামিয়া, শিক্ষার্থী, একাদশ শ্রেণি, নৌবাহিনী কলেজ, ঢাকা

শিল্প-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সব ধারায় নারীরা সমাজের উন্নতিসাধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। মা, বোন, সহধর্মিণী কিংবা সহকর্মীরূপে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরা কাজ করছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে নারীর সিংহভাগ উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীরা এখনও নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী এখনও সামাজিক কুসংস্কার, গোঁড়ামি, ফতোয়া ইত্যাদি নারীর পথে বাধা হয়ে রয়েছে। এখনও বিশ্বে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ নারী এবং বেকার জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ নারী। আমরা ইতিহাস থেকে দেখতে পাই নারীরা বরাবরই মুক্তিকামী। পুরুষের অধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীরা বহু বছর ধরেই সংগ্রাম করে আসছেন। নারী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন ৮ মার্চ। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমর্থন প্রদানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমান একুশ শতকের এই আধুনিক যুগে আমরা নারীমুক্তির অনেকটা একাংশে পৌঁছতে পেরেছি। এটাই সত্য যে গত তিন দশকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকাসহ পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নারীর ব্যাপক অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। বেগম রোকেয়া থেকে সুফিয়া কামালের আমল পর্যন্ত স্বীয় অধিকার আদায় ও মুক্তির সংগ্রামের যে ধারা প্রচলিত ছিল তা আজও আমাদের দেশের স্বর্ণ কিশোরীদের মধ্যে বিদ্যমান। বস্তুত নারীর অবস্থান দেখে বিবেচনা করা যায় একটি দেশ কতখানি সভ্য ও উন্নত। চব্বিশের স্বাধীনতায় নারীর উন্নয়নকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাধীনতার ধারা অব্যাহত রাখতে হলে নারীমুক্তির পথকে মসৃণ ও সুগম করতে হবে।

সংগ্রাম, স্বপ্ন ও স্বীকৃতির প্রতিচিত্র

দীপা সাহা প্রিয়া, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

কথিত আছে, নারীরা ফুলের মতো নমনীয়; তাদের ধনুকের মতো টানটান করতে গেলে ভেঙে যাবে। কিন্তু নারী শুধু ভালোবাসার প্রতিমূর্তিই নয়; মমতার নদী, সাহসের আগুন, সৃষ্টির স্পন্দন। নারী ফুল, নাকি আগুনের ফুলকি সেই আপেক্ষিকতা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। নারী দিবস সেই লড়াইয়েরই স্বীকৃতি, নারী অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিন। পত্রপত্রিকা খুললেই বর্তমানে নারী নির্যাতন, লাঞ্ছনা, শ্রীলতাহানির খবর অহরহ দেখা যায়। তবে নারীর প্রতি নির্যাতন শুধু শারীরিকই নয়, মানসিকও। ৩০০ বছর আগে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মেয়েরা পুরুষের তুলনায় অক্ষম ও স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন। অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে যুগের পর যুগ ধরে পুরুষরা তোতাপাখির মতো একই সুরে গান গেয়ে যাচ্ছে। আইনি সুরক্ষা সত্ত্বেও এখনও ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা ও ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। কর্মক্ষেত্রে এখনও নারী শতভাগ নিরাপদ নয়। নারী দিবসে শুধু আইন নয়, সামাজিকভাবে সচেতন হলেই নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। পরিবার থেকেই নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাধা পেরোনোর স্বপ্ন দেখতে হবে

মুমু ঘোষ, শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রথম যখন মাতৃকোলে জায়গা করে নিয়েছিলাম তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা বলেছিল, ‘একি বউমা, মেয়ে হয়েছে? বংশের আলো এবার নিভল বলে।’ সেই প্রথম অবুঝ মন আমার জানান দিয়েছিল, আগামীর পথ আমার সহজ হবে না। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সংগ্রাম আমি কম করিনি। পড়তে বসলে শুনতাম, ‘হুম ঢং! কী হবে এত পড়ালেখা করে শুনি? সেই তো বিয়ে করে বাসন মাজবি।’ ঘরের কাজ করলে শুনেছি, ‘হ্যাঁ, পড়ালেখা তো আর হবে না তুই বরং কাজটাই মন দিয়ে কর, ওটাই কাজে দেবে।’ আর স্বপ্ন? সেটা আবার কী শুনি? মেয়ে মানুষের স্বপ্ন দেখতে নেই। এ গল্পটি শুধু আমার নয়, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেক মেয়েকেই বেড়ে উঠতে হয় এমন পরিবেশের মধ্য দিয়ে, যেন জন্মই আমার আজন্ম পাপ। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাই আমি প্রত্যাশা করি, যেন আমাদের সমাজে নারীকে অভিশাপ ভাবা না হয়। এ সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।