সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও এই জগৎ!

মাহমুদ রেজা চৌধুরী
০৮ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও এই জগৎ!

এটা একটা বিশাল প্রভাবশালী ক্ষেত্র নিঃসন্দেহে। সমাজ, রাষ্ট্র এবং নীতি-নৈতিকতার জগতেও। পাশাপাশি বিচিত্র ও বৈচিত্র্যেও ভরা। সাংঘাতিকও বটে। যে কারণে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকদের সম্পর্কে কিছু বলা মানে গরম তেলের কড়াইতে হাত ডুবিয়ে দেওয়া!’ তাই এই বিষয়ে বলা বা লেখাও সহজ নয়।

বিশ্বের বিখ্যাত কয়েকজন সাংবাদিকের মধ্যে যাদের আধুনিক সাংবাদিকতার জগতে অগ্রদূত বলা হয়, যেমন : জোসেফ পুলিৎজার (১৮৪৭-১৯১১)। আরও কয়েকজন সাংবাদিকের কথাও মনে পড়ে, যাদের কথা বিভিন্ন জায়গায় পড়ি ও শুনি। যেমন, বব উডওয়ার্ড, অ্যান্ডারসন কুপার, ডেভিড হালবারসটন, লেসটার হল্ট, ফ্রেডরিক হোয়াইট ফিল্ড, হু শুলি, ওয়ালটার কংক্রিট, বারবারা ওয়ালটার,

ডায়ান সোয়ার, রবিন রবার্টস, ক্রিশ্চিয়ান আমপুরা, ফরিদ জাকারিয়া, মেহেদী হাসান, অরিয়ানা ফালাচি। এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ। এ রকম আরও অনেকেই যারা বিশ্ব সাংবাদিকতার জগতে শ্রদ্ধেয় নাম। তাদের কথা, তাদের রিপোর্ট, তাদের লেখা, সারা বিশ্ব শোনে, পড়ে ও দেখে।

আমাদের বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের কয়েকজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ছিলেন। তাদের অনেকেই পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত।

যেমনÑ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আব্দুস সালাম, খন্দকার আব্দুল হামিদ, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ, নির্মল সেন, ওবায়দুল হক, জহুর হোসেন চৌধুরী, সানাউল্লাহ নূরী, আবু জাফর শামসুদ্দিন, এবিএম মূসা, আব্দুল হামিদ, এনায়েতুল্লাহ খান, নুরজাহান বেগম, ফয়েজ আহমেদ, রোকনুজ্জামান খান, আব্দুল ওয়াহাব প্রমুখ শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ও কলামিস্ট। তারা আমাদের বাংলাদেশের গৌরব, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসে স্মরণীয়।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও কয়েকজন বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে নাম করতে হয় যেমনÑ অক্ষয় কুমার দত্ত, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিকেত চট্টোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ, অমিতাভ চৌধুরী, অরুণ মিত্র, রাজীব ঘোষ, অনরব গোস্বামী। এ রকম আরও অনেকেই আছেন। সবার কথা মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। উল্লেখিত সবাই সাংবাদিকতার জগতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে অনেকের কাছেই সুপরিচিত। তাদের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

পাশাপাশি আমাদের বাংলাদেশে এখনো অনেক সাংবাদিক আছেন যারা নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সততা এবং নৈতিকতাকে বজায় রেখে। তারা আত্মপ্রচারে একেবারেই ব্যস্ত না কেউ। তাই তাদের কথা আমরা অনেকে সেভাবে শুনি না বা জানি না। বর্তমানে বাংলাদেশে এ রকম সাংবাদিকদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এবং ভক্তি আছে এবং থাকবে।

সেদিন নিউইয়র্কের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দেশ’-এর ৫ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রবীণ আরেক শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক, মনজুর আহমদ। তার একটা লেখার দিকে চোখ পড়ে। লেখার শিরোনাম, ‘পত্রিকা আছে, সাংবাদিক নেই।’ লেখক এখানে বিশেষ করে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত প্রায় ডজনখানেক পত্রপত্রিকার সাংবাদিকদের প্রসঙ্গে লিখেছেন। তার মতে, এখানে যত পত্রিকা প্রতি সপ্তাহে বের হয়, সেই তুলনায় সত্যিকার অর্থে ‘সাংবাদিক’ নেই।

স্রেফ জীবনযাপনের তাগিদে অনেকে দেশ থেকে এখানে এসে নিজেদের সাংবাদিকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু তারা সাংবাদিক নন।

তার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি ‘একটি পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে নাম ছাপানোর বিষয়টিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। একটি পাতায় অনেকটাজুড়ে পত্রিকাটি অনেকগুলো নাম ছাপছে তাদের ছবিসহ। প্রিন্টার্স লাইনের ছবির ব্যবহার আর কোথাও কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এ পত্রিকাটির মালিক স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। তবে তিনি পত্রিকার সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত করেছেন তার স্ত্রীকে, সাংবাদিক হিসেবে যার কোনো পরিচিতি কখনো শোনা যায়নি। অবশ্য তারা মুখ রক্ষা করেছেন একজন প্রবীণ সাংবাদিককে উপদেষ্টা হিসেবে রেখে।’ তাই হয়তো প্রবীণ ও গুণী সাংবাদিক মঞ্জুর আহমদ? এখন (নিউইয়র্ক প্রবাসী) দুঃখ করেই লিখেছেন, ‘পত্রিকা আছে সাংবাদিক নেই।’

বিষয়টা কি কেবলই নিউইয়র্কেই প্রযোজ্য কিনা জানি না। তবে বিষয়টা ইদানীং বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। একটু ব্যতিক্রম, ওখানে সাংবাদিক আছে, কিন্তু ‘সাংবাদিকতা’ কম। বেশির ভাগটাই ‘হলুদ’ সাংবাদিকতায় ভরা। অর্থাৎ নেতিবাচক সমালোচনা এবং উসকানি ছড়ানোই এদের মূল কাজ। এদের মধ্যে অনেককে বলা যায় ‘জিপিএস সাংবাদিক’। এরা কে, কখন, কবে, কোথায় থাকবেন। কোন টেলিভিশনে কোনদিন কথা বলবেন। তাদের ভক্ত ও পাঠকদের আগাম জানিয়ে দেন দেখতে। জিপিএস যেমন আপনার গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই পথ বলে দেয়।

আরেক দল আছেন বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তারা প্রত্যেকেই প্রতিদিন নিজ, নিজ ঘরে বসে মনের মাধুরী মিশিয়ে নানান সংবাদ পরিবেশন করেন। সেখানে সাংবাদিকতার দূরদৃষ্টি, পেশাদারত্ব, নৈতিকতা, ভদ্রতা, বিনয় থাকুক বা না থাকুক। এগুলো বড় বিষয় নয়। বিষয় আত্মপ্রচার এবং অপেশাসুলভ বয়ান প্রচার। এই সংখ্যাটা এখন বাংলাদেশেও বাড়ছে।

এতে কী লাভ? লাভ হচ্ছে, এই প্রচারের যুগে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আপনি কোথাও না কোথাও নিজের স্থান নিজে করে নিচ্ছেন সেটা কেউ পছন্দ করুক বা না করুক। এক ধরনের আধিপত্য, এক ধরনের আমি, আমি এবং খবরের অপব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ দিয়ে আত্মপ্রচারের প্রতিযোগিতায় থাকা। এর বাইরে আর কোনো লাভ আছে কিনা তা অবশ্য জানি না।

ক্ষতি কী তাতে! অনেক বড় ক্ষতি। এই সাংবাদিকরা অনেক বড় ক্ষতি করছেন সমাজের যতটা না ভালো করেন। ফলে সাংবাদিকদের প্রতি এবং এই পেশায় সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও আস্থা কমে যাচ্ছে। সবাই একটা কিছু হতে চাচ্ছি আমরা। কিন্তু সবাই সবকিছু হতে পারি কিনা, চিন্তা করি না। একইভাবে সবাই কথা বলতে চাই। কিন্তু সবাই সব কথা বলতেও পারি কিনা! সেটাও ভাবি না। ব্যক্তি স্বাধীনতার নেতিবাচক দিকগুলো এভাবেই প্রসারিত হচ্ছে। এতে সার্বিক স্বাধীনতা ও পেশা নষ্ট হয়। এজন্য অনেকেই বলেন, এক সময় মানুষ সংবাদপত্র পড়ত সত্য জানার জন্য। এখন মানুষ সংবাদপত্র পড়ে না সেখানে সত্য না থাকার কারণে!

আমরা জানি, ১৭০২ সালে প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ডের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘দি ডেইলি করানট’ (ঞযব উধরষু ঈড়ঁৎধহঃ).

তখন থেকেই সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ ও রাষ্ট্রের আয়না হিসেবেও এর জয়-পরাজয়ের তাৎক্ষণিক চিত্র আমাদের তুলে দিয়েছে। সেই চিত্রটি দেখে এক সময় আমরা সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারতাম। এখন সেটা পারি কি! কখনও পারলেও সেটা অর্ধেক সত্য, আর অর্ধেক থাকে মিথ্যা।

কখনও কখনও মনে হয়, আপনি চিৎকার করে বলছেন (মানে, আপনি যদি চান) কেউ তো আমার স্বাধীন ইচ্ছা পরিবর্তন করতে পারছে না। সবাইকে শুধু একটা ব্যাপারে মাথা ঘামালেই চলে, আমার ইচ্ছা নিজের ইচ্ছার সঙ্গেও লড়ছে। আমাদের অনেক সাংবাদিকের আচার-আচরণ এবং কথাবার্তায় তাই মনে হয়। যা খুশি বলছেন, যেমন খুশি তাদের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ‘অফুরন্ত’ স্বাধীনতা। অফুরন্ত স্বাধীনতার পরিণতি কী হয়, সেটাও আমরা দেখি। অফুরন্ত স্বাধীনতায় সত্যিকারের স্বাধীনতার পায়ে শেকল পরে। তখন সত্য পরাজিত হয়, মিথ্যা বিজয়ী হয়। সাংবাদিকতা ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ নয়, এটা ‘এনলাইটেনমেন্ট’। আমাদের দেশের অনেক সাংবাদিকের এই জ্ঞানটা এখন তেমন নেই। তারা এন্টারটেইনমেন্টেই ব্যস্ত বলে মনে হয়। কোথাও কোথাও ভাঁড়ের ভূমিকাও পালন করেন। এর একটা কারণ হতে পারে, বিংশ শতাব্দীতে সংবাদপত্রের আরেকটা বিশেষ ঘরানা ‘ট্যাবলয়েড’ পত্রিকার বাজার সৃষ্টিতে সংবাদ পরিবেশনের গভীরতা ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক কমানো হয়েছে। সেখানে সংবাদের চেয়ে ছবির সংখ্যা বেশি। সেটা যে কোনো ছবিই হতে পারে। ব্যঙ্গচিত্র হোক বা ঘটনার সত্য চিত্র। এই কারণেও সংবাদপত্র, সাংবাদিক জগৎ, সংবাদ সৃষ্টি এবং এর পরিবেশনায় গভীরতা কমে যাচ্ছে কি না! বিজ্ঞজনরাই ভালো বলতে পারবেন।

দেশে এক সময় যেসব সাংবাদিক কথা বলতে ভয় পেতেন, কথা বলতেন না। তোষামোদ করতেন। চাটুকার ছিলেন। লিখতেন না। একমাত্র কর্তার ইচ্ছায় কর্ম ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। তাদের মধ্যে অনেকে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেছেন ও যাচ্ছেন। তাদের পেশাদারত্বের ভূমিকা দেখাচ্ছেন। কিন্তু ভুল পথে। সাংবাদিক না হয়ে সংবাদপত্রের সাধারণ পাঠক হিসেবে তাই মনে হয়। কতটা গরম তেলে হাত দিলাম কে জানে!


মাহমুদ রেজা চৌধুরী : লেখক ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষক