নগদ টাকার অভাবে পেট্রোবাংলা

লুৎফর রহমান কাকন
০৪ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নগদ টাকার অভাবে পেট্রোবাংলা

বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) নানামুখী সংকটে দিন পার করছে। প্রতিনিয়ত দেশে গ্যাসের সংকট বাড়ছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান নেই। একদিকে নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাসের জোগান কমছে, অন্যদিকে আর্থিক সংকটে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি। এত দিন ডলার সংকটে আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছিল না পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ডলারের সংস্থান হলেও এখন নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কারণ ডলার পেতে দরকার নগদ টাকা। প্রধানত বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকে আদায় করা অর্থ দিয়েই এলএনজি আমদানি করতে হয়। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো নিজেরাও ধুঁকছে অর্থ সংকটে, বিশেষ করে সারকারখানাসহ সরকারি-বেসরকারি শিল্প-গ্রাহকদের কাছে বিপুল অর্থ বকেয়া পড়ায় যথাসময়ে পেট্রোবাংলা পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে প্রতিদিন বিতরণ কোম্পানিগুলো কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করছে সে দিকে তাদিয়ে থাকতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে।

এই অবস্থায় গ্যাস আমদানি ও সরবরাহ নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ একাধিক এলএনজি সরবরাহকারী এবং বিদেশি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানি পেট্রোবাংলাকে জানিয়ে দিয়েছে, নিয়মিত পাওনা পরিশোধ না করলে তারা চুক্তি বাতিল করবে।

পেট্রোবাংলার একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এখন আমাদের প্রতিদিনের কাজ হচ্ছে- সকালে এসেই চেয়ারম্যানের রুমে মিটিং করা। সেসব মিটিংয়ে মূলত আলোচনা হয় পেট্রোবাংলার অধীন বিভিন্ন কোম্পানি থেকে টাকা সংগ্রহ করে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করা।

আরেক কর্মকর্তা বলেন, এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোও এখন তেমন টাকা দিতে পারছে না। নানা কারণে তাদের আয়ও কমে গেছে। এ ছাড়া গ্যাসের সবচেয়ে বড় গ্রাহক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সারকারখানাগুলো নিয়মিত বিল পরিশোধ না করায় বিশাল পরিমাণ অর্থ এখন বকেয়া পড়ে আছে। এ টাকা আদায় করতে দফায় দফায় বৈঠক করা হলেও কার্যত টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে পেট্রোবাংলা এখন টাকার সংকটে পড়েছে। আরেক কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি (আইওসি) এবং এলএনজি সরবরাহকারী একাধিক কোম্পানি পেট্রোবাংলাকে নিয়মিত পাওনা পরিশোধ করতে অনুরোধ করেছে। তা না হলে চুক্তি বাতিল করতে পারে- এমন সর্তকতাও দিয়েছে গ্যাস সরবরাহকারীরা।

এদিকে পেট্রোবাংলা থেকে নিয়ে গ্যাস বিক্রির অর্থ সংগ্রহ করে পেট্রোবাংলার কোষাগারে টাকা জমা দেন এমন একটি বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, নানা অসঙ্গতির কারণে আমাদের রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গ্যাস বিক্রি করে সবচেয়ে বেশি অর্থ দেই আমরা। যদিও এটা সরকারেরই অর্থ। তবু নানা অসঙ্গতির কারণে এখন রাজস্ব আদায় কমে গেছে। আমাদের কোম্পানিই এখন লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় শিল্পকারখানা, যেগুলোর অনেক বকেয়া- এমন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে তদবির আসছে সেগুলোর যাতে লাইন কাটা না হয়। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস বিল বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা পাওনা আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে পুরো গ্যাস খাত এখন একটি নড়বড়ে অবস্থায় পড়েছে। এ কর্মকর্তা বলেন, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত পেট্রোবাংলা থেকে চাপ আসছে টাকা পরিশোধ করতে; কিন্তু কোম্পানি যদি টাকা আদায় করতে না পারে তা হলে পরিশোধ করবে কীভাবে?

প্রসঙ্গত, বিগত প্রায় এক দশক ধরেই চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের জোগান ও সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছে পেট্রোবাংলা। প্রতিষ্ঠানটির সূত্রমতে, ৮টি গ্রাহক শ্রেণিতে গ্যাসের অনুমোদিত লোড প্রায় ৫ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। এর ফলে ইতোমধ্যে প্রায় ৫০০ শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বিদ্যমান শত শত কারখানা গ্যাসের সংকটে ধুঁকছে। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এখনও বিভিন্ন সরবরাহকারী সরকারের কাছে বিশাল পরিমাণ অর্থ পাওনা রয়েছে। একই সঙ্গে সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর

ওপর প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি ও সরবরাহের চাপ রয়েছে। তবে এলএনজি আমদানি করতে বা পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে প্রয়োজনীয় অর্থের ছাড় মিলছে না। ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলছে না।

পেট্রোবাংলার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমদের সময়কে বলেন, এখন ডলারের দাম প্রায় ১৩০ টাকায় উঠে গেছে। চলতি বছরের জন্য ১১৫টি এলএনজি কার্গো আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রতিটি এলএনজি আমদানি করতে গড়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা লাগে। এ বিশাল পরিমাণ এলএনজি আমদানি সত্যি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া দেশি উৎস থেকে ক্রমাগত গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় পেট্রোবাংলা বেশি উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা পাওনা। অন্যান্য কোম্পানি-সংস্থাগুলোর কাছে আরও বকেয়া পাওনা ১০ হাজার কোটি টাকা।