৬১ শতাংশ কাজ বাগিয়ে নেন ৫ শতাংশ ঠিকাদার

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
৬১ শতাংশ কাজ বাগিয়ে নেন ৫ শতাংশ ঠিকাদার

ই-জিপি বা অনলাইন দরপত্রের মাধ্যমে সরকারি কেনাকাটার ব্যবস্থা চালুর এক যুগের তথ্য বিশ্লেষণ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে- সবচেয়ে বেশি খরুচে ১০ মন্ত্রণালয়ে মাত্র ৫ শতাংশ ঠিকাদার বাগিয়েছেন ৬১ শতাংশ প্রকল্পের কাজ। আর সব মন্ত্রণালয়ের নিরিখে সবচেয়ে কম কাজ পাওয়া ১০ শতাংশ ঠিকাদারের বাজার হিস্যা ১ শতাংশেরও কম। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ- আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি কেনাকাটার ‘বাজার দখল’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।

‘বাংলাদেশের ই-ক্রয়কার্য : একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব (২০১২-২০১৪)’ শীর্ষক এক গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে, জানিয়েছে টিআইবি। গতকাল মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে নিজেদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ২০১১ সালে ই-জিপি চালুর পর থেকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পকাজ দেওয়া হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ অনুমোদিত চুক্তির মূল্য ছিল ৮৮১ কোটি টাকা। এর চেয়ে বড় চুক্তিমূল্যের কাজকে এখনও এ প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনা হয়নি। শীর্ষ ১০

মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার মোট চুক্তির মূল্যের ৬১.৩১ শতাংশ অর্জন করেছে, অন্যদিকে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ ঠিকাদারের বাজার অংশীদারিত্ব সব মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ শতাংশ এরও কম।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারি কেনাকাটায় প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে উঠার কথা থাকলেও তা গড়ে ওঠেনি। উল্টো মন্ত্রণালয়গুলোতে ঠিকাদারদের অসম প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা গেছে।

বাজার হিস্যা তুলে ধরতে গিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার এক দশকে তাদের বাজার অংশীদারত্ব বৃদ্ধি করেছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে মাত্র ১১ শতাংশ (৩৮৪ জন) ঠিকাদার ৯৩.৫৫ শতাংশ মোট চুক্তিমূল্যের কাজ করেছে। ৩৫ জন ঠিকাদারই ৭২.৯ শতাংশ বাজার দখল করেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৯ শতাংশ (৩৩৬ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৯১.৫ শতাংশ কাজ করেছে। মাত্র ৩৮ জন ঠিকাদার ৩০.৯ শতাংশ বাজার দখল করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৭.৪৫ শতাংশ (৬০৭ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৭১ শতাংশ কাজ করেছে। ৮১ জন ঠিকাদার ৩২.৩২ শতাংশ বাজার দখল করেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগে ৯.৭৪ শতাংশ (২৮৬৫ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৬২.৮৮ শতাংশ কাজ করেছে। ২৯৪ জন ঠিকাদার ২৭.৭ শতাংশ বাজার দখল করেছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি ক্রয়খাত সারাবিশ্বেই সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ, তবে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণহীন দখলদারিত্বের হাতে জিম্মিদশায় নিমজ্জিত হয়েছে। ২০১৮ সালে আমাদের একটি গবেষণায় আমরা দেখেছি যে, প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়খাতের দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য মোট ক্রয় বাজেটের ২৭ শতাংশ পর্যন্ত অপচয় হয়। প্রত্যাশা ছিল, ই-জিপি ব্যবস্থার মাধ্যমে এ ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে; উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হবে; সরকারি ক্রয়খাতে দুর্নীতি কমবে এবং ব্যয়িত অর্থের সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো- ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়নি।

সরকারি কেনাকাটায় যোগসাজশে দুর্নীতি হয় উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, স্থানীয় সরকার বা মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব জায়গায় ঠিকাদারের হাতবদল হয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ সেই একই মাত্রায় রয়ে গেছে। সার্বিকভাবে সরকারি ক্রয় খাত নিয়ন্ত্রিত অবস্থা ও জিম্মিদশায় আছে। যখন হাতবদল হয়, তখন নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকে, কিন্তু হাতবদল হয়।

টিআইবির সুপারিশসমূহ

গবেষণা প্রতিবেদনের সরকারি ই-প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) কাছে বেশকিছু সুপারিশ জানায় টিআইবি। সেগুলো হলো- যুগ্ম উদ্যোগ (জেভি) ফার্মগুলোর কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যালোচনা করা; স্বাধীন পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে ঠিকাদারদের যোগসাজশ ও বাজার দখলের প্রবণতা রোধ করা; একক ঠিকাদার সক্ষম হলে জেভি সীমিত করা; যে ঠিকাদার এককভাবে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম, তাকে জেভি গঠনের অনুমতি না দেওয়া; বাজার দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া; ঠিকাদারদের জন্য বাজার শেয়ারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা; আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসরণ করা; সরকারি ক্রয়ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মানের নিয়মনীতি ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা; প্রকৃত মালিকানা তথ্য প্রকাশ করা; পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস সংশোধন করে সকল কোম্পানি ও জেভির প্রকৃত মালিকানা তথ্য উন্মুক্ত করা; উচ্চমূল্যের চুক্তি ই-প্রকিউরমেন্টের আওতায় আনা এবং ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের বাইরে থাকা উচ্চমূল্যের প্রকল্পগুলোকে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় আনা।