আবেগঘন এক মশাল মিছিলের নাম বইমেলা

দিলারা হাফিজ :: কবি ও গবেষক
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আবেগঘন এক মশাল মিছিলের নাম বইমেলা

‘বই’ শব্দটি বাংলা। সংস্কৃত ভাষার ‘মেলা’ শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের অতিপ্রিয় বইমেলা শব্দটির উদ্ভব ও অনুভব। মেলা শব্দটি ব্যাপকার্থে কোনো বিশেষ একটি পেশাজীবী গ্রুপের পণ্য বিক্রয়, প্রচার এবং ক্রেতাসাধারণকে কিনতে ও বইপাঠে আগ্রহ জাগানোর জন্য সাধারণত প্রকাশক বা বই বিক্রেতাদের একটি দলগত প্রয়াসে একক প্রদর্শনীর ব্যবস্থার নাম বইমেলা। বইমেলা ঘিরে রয়েছে আমাদের ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতির নিরন্তর ভালোবাসা ও ভালো-লাগার খেলা। বাঙালির মেধা-মননের অনন্য সাধারণ এক আবেগঘন মশাল মিছিলের নাম বইমেলা। এই মেলা আমাদের প্রাণের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ। 

এই অনুভূতি এতটাই প্রাণ-সঞ্চারি, এতটা স্বদেশপ্রেম সঞ্চারী যে, বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলন ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে ৭২ বছর পরও নব উদ্দীপনায় বাঙালির জাতীয় জীবনের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণে বীজমন্ত্রের ভূমিকায় কাজ করে চলেছে। একইভাবে সারা বছর প্রতীক্ষিত এ বইমেলা জাতীয় জীবনের অসাম্প্রদায়িক এক উৎসবে পরিণত হয়েছে বৈকি।

যে কোনো উৎসব মানেই এক ধরনের অঙ্গীকার। মায়ের মুখের ভাষার অধিকার ছিনিয়ে আনার অঙ্গীকার থেকে যেমন ভাষা আন্দোলন হয়েছে, রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে যে পাঁচ ভাষাশহীদের আত্মত্যাগের মহিমা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে প্রাণিত করেছে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজ বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১০০টির মতো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুষদ খুলেছে। সেসব বিভাগে বিদেশিরা বাংলা শিখছে। বিরল এই সম্মান, গৌরব ও অর্জন এসেছে ভাষা আন্দোলনের ফলে। বাঙালিরা আজ তাই ফেব্রুয়ারিকে ‘ভাষার মাস’ নামে ডাকে। সেই ভাষাসৈনিকদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় স্মরণ করাও বইমেলার একটি অলিখিত মূলমন্ত্র। বলা বাহুল্য, ভাষা আন্দোলনের অমøান স্মৃতিশক্তি লাবণ্যময় করে তুলেছে বাংলা একাডেমি চত্ব¡রের এ বইমেলা।

নবীন-প্রবীণ সব কবি-সাহিত্যিকের প্রধান প্রবণতা লক্ষ্য করেছি মেলাকে সামনে রেখে বই প্রকাশ করা। একজন কবি হিসেবে আমিও এর বাইরে নই। এই সময় বই প্রকাশ পেলে প্রচারের যেমন একটি সুবিধে থাকে, তেমনি দেশের দূর-দূরান্ত থেকে মেলায় আসা কবি-লেখক-সাহিত্যিক নিজেরাও পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন, বইমেলা সূত্রে বছরে হয়তো একবার হলেও দেখা হয় অনেকের সঙ্গে। বলা যায়, মেধা-মননের হাট বসে যায় এই বইমেলা ঘিরে। বিভিন্ন মিডিয়া সোচ্চার হয়ে ওঠে আগত কবি ও লেখকদের সাক্ষাৎকার প্রকাশে।

প্রবাসে যারা বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন, তারাও দেশে ফিরে আসেন এই ভাষার মাসে। বইমেলায় বসে অটোগ্রাফ দিয়ে বই বিক্রির একটা প্রচলন গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যে। এই ধারার প্রচলনটি কবি শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণের হাত ধরে যাত্রা শুরু করলেও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনের হাতে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। এই সূত্রে কবি-লেখক ও পাঠকের মধ্যে জীবনসঞ্চারী এক ধরনের বন্ধুত্বের সেতু রচিত হয়েছে।

বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তাল মেলানোর কিছু নেই। আমি মনে করি, বাংলা সাহিত্য তার মাটি ও মানুষের জীবনপ্রবাহ নিয়ে আপন গতিতেই পথ করে চলে এবং চলছে। ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের নভেল এসেছে গীতাঞ্জলির মাধ্যমে, যা একান্তই পূর্বদেশীয় বা প্রাচ্য সাহিত্য হিসেবে গণ্য। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য চিরকালই আলাদা। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে খুব সহজেই বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি আমরা। যে কেউ চাইলে তা অনুসরণ ও আত্মস্থ করে নিজস্ব একটি কণ্ঠস্বর তৈরি করতেই পারেন। ইতোমধ্যে সেই চর্চার কিছুটা আঁচ পাই তরুণদের লেখায়।

আমি নিজেও মেলায় যেন অন্তত একটি বই প্রকাশ হতে পারে, সেভাবে তার প্রস্তুতি হিসেবে পাণ্ডুলিপিটি তৈরি করতে চেষ্টা করি নভেম্বরের আগেই। এ বছর আমার একটি স্বনির্বাচিত বের করব বলে বছরের শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। প্রকাশনা শিল্পের পক্ষে জলধি সাগ্রহে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু পাণ্ডুলিপি কাটাছেঁড়া করতে আমিই দেরি করলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, স্বনির্বাচিত শব্দটি ব্যবহৃত হতে হতে খুব ক্লিশে শোনায়। কাজেই ভিন্ন একটি নাম খুঁজে দিলাম ‘একগুচ্ছ দিলারা হাফিজ’। পাঠকমহলে বেশ সাড়া পড়েছে এ নামটি!