সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ডিসিদের নির্দেশ
২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। রিটার্নিং অফিসার হিসেবে সুষ্ঠু নির্বাচনে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে তাদের। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সে দায় এড়াতে পারেন না তারা। এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্নের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। সম্মেলনের প্রথম দিন গতকাল পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ডিসিদের প্রতি একটা অনুরোধ ছিল, একটা তো হচ্ছে সামনে একটা নির্বাচন আসছে, সেটি কীভাবে সুষ্ঠু করা যায়। আমাদের সরকারের প্রধান কাজ সবার দাবি-দাওয়া মেটানো নয়। একটা সুশাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যাতে উত্তরণ হয়, সেক্ষেত্রে তারা সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে হয়।
রাজধানীর ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল রবিবার ডিসি সম্মেলনে দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন ছিল জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও পরিকল্পনা বিভাগের সেশন। অধিবেশনে অংশ নেওয়া জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এমপিওভুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত আয় ও ব্যয়-সংক্রান্ত নীতিমালার প্রস্তাব দিয়েছেন জেলা প্রশাসকরা। জেলায় স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্তি ও জাতীয়করণের সময় জেলা প্রশাসকের মতামত গ্রহণেরও প্রস্তাব দেন তারা। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা রোধ, অনিয়ম এবং দুর্নীতি রোধে ডিসিদের নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ড. এম আমিনুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ। আরও উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিব এবং অধিদপ্তরের মহাপরিচালকরা। এর আগে সকালে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
জানা গেছে, ডিসি সম্মেলনে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. ফরিদুর রহমান প্রস্তাব করেছেন, এমপিওভুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়-ব্যয় সংক্রান্ত নীতিমালা করার। বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রস্তাব করেছেন, জেলায় স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্তি ও জাতীয়করণের সময় জেলা প্রশাসকের মতামত গ্রহণের। পাবনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম এক শিক্ষাবর্ষে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় খাতভিত্তিক ফি আদায় এবং আদায়কৃত ফি ব্যয় সম্পর্কিত নীতিমালা করার প্রস্তাব করেছেন। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম।
অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো শেষ করতে নির্দেশনা : অসমাপ্ত প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে যে প্রকল্পগুলো চলছে, সেগুলোয় অনেক অসুবিধা তৈরি হয়েছে। অনেক প্রকল্পের ঠিকাদারকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক প্রকল্পের টাকা তারা নিয়ে চলে গেছে। আবার অনেক অসমাপ্ত প্রকল্প রয়েছে। এ ছাড়া আগে যেমন স্থানীয় প্রতিনিধি ছিল, তাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্প নেওয়া হলেও চাহিদা ছিল। এখন তারা নেই। ডিসিদের বলেছি, নিজেদের উদ্যোগেই স্থানীয়ভাবে জনহিতকর প্রকল্পগুলো চালু করতে হবে। যেমন- রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, অনেক রাস্তা আছে কিন্তু সেতু নষ্ট হয়ে গেছে, কোথাও স্কুলঘর আছে কিন্তু ভগ্নদশা- এগুলো নিজেদের উদ্যোগেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে।
শিক্ষা প্রশাসনে অনিয়ম-দুর্নীতি নজরদারির নির্দেশ : অধিবেশন শেষে পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানান, শিক্ষা প্রশাসনে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে; এগুলো নজরদারি করতে বলেছি। অনেক শিক্ষক তাদের ভাতা ঠিকমতো পান না। অনেক স্কুল পরিদর্শদের হেনস্তার শিকার হন শিক্ষকরা। দুই পক্ষের দোষ থাকে- এগুলো নজরদারি দরকার। বেসরকারি স্কুল এবং কলেজের পরিচালনা বোর্ডগুলো নিয়েও সমস্যা রয়েছে। যারা ছিল তারা চলে গেছে এবং চর দখলের মতো নতুন প্রভাবশালীরা দখলের চেষ্টা করেছে। আমরা প্রাথমিকভাবে বেসরকারি স্কুল এবং কলেজের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করেছিলাম, তারা ডিসি বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হোক। কিন্তু এতগুলো দায়িত্ব তাদের পক্ষে নেওয়া কঠিন।
ভালো ও সৎ মানুষদের পরিচালনা কমিটিতে : উপদেষ্টা বলেন, আমরা পরামর্শ দিয়েছি বেসরকারি স্কুল কলেজের পরিচালনা পর্ষদগুলো আবার শুরু করতে। সেটা করতে গিয়ে তারা অন্তত এ সময়ে যেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে স্থানীয় যারা ভালো ও সৎ মানুষ আছেন, সবাই যাদের গণ্য করেন; তাদের মধ্যে সরকারি চাকুরে আছেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আছেন- এ ধরনের মানুষকে যেন পরিচালনা পর্ষদে নেয়। যাতে শিক্ষকরা তাদের চাকরি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার না হন। তাতেও যদি কাজ না হয়, আমরা মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি পরিপত্র জারি করেছিলাম, স্কুলের পরিচালনা পর্ষদে অন্তত বিএ পাস এবং কলেজ পর্ষদে অন্তত মাস্টার্স ডিগ্রি হতে হবে। এটাতে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক চাপ অনেকটা সামলাতে সুবিধা হয়েছে।
বই প্রসঙ্গ : ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ বছরের যেকোনো কারণেই হোক পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে, বিতরণ শুরু করতে অনেক বিলম্ব হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা বলেছিলাম, যে বিষয়গুলোর বার্ষিক পরীক্ষা হবে, সেই বইগুলো ফেব্রুয়ারির মধ্যে চলে যাবে। আমরা আগেই বলে দিয়েছি, প্রান্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন আগে বই চলে যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের নামে কিছু হবে না : উপদেষ্টা আরও জানান, আরেকটি পরামর্শ তাদের দিয়েছি, যেহেতু তারা নিজ নিজ এলাকায় ছোট শহরে থাকেন; সেই শহরগুলোয় আমি ছোটকালে যা দেখেছি, তখনকার দিনে যারা জেলা বা মহকুমার প্রশাসক ছিলেন তারা কিন্তু একটা কিছু সেই শহরের জন্য রেখে যেতেন। সেটা একটা সুন্দর দিঘি, স্টেডিয়াম, স্কুল বা একটা সুন্দর পার্ক হোক- ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিয়েছি আপনারা প্রত্যেকটা শহরে যে যেখানে আছেন, একটা কিছু নিদর্শন রেখে যাবেন। যাতে অনেক পরও সবাই বলতে পারেন, আপনি ওই শহরের প্রশাসক ছিলেন। আজকাল তো রাজনীতিক নামে ছাড়া কিছু হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের নামে কিন্তু কোথাও কিছু হবে না। আমরা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে চাই না, আমাদের কাজ সুন্দর একটা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
অবসর ভাতার জন্য বন্ড সুবিধা আসছে : পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষা খাতে সবচেয়ে অবহেলিত সরকারি খাতে এমপিভুক্ত স্কুল শিক্ষকরা। এ জন্য আমাদের যতদূর করার চেষ্টা করব। তাদের অনলাইন বদলির ব্যবস্থা করেছি। তারা যে ভাতাগুলো পান অপ্রতুল। আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে ভাতাগুলো যতটা বাড়ানো যায়, চেষ্টা করে যাচ্ছি। আগামী বছরের জন্য একটা বাজেট তৈরি হচ্ছে। শিক্ষকদের অবসরকালীন যে সুবিধা পাওয়া, সেটা তাদেরই টাকা। এগুলো তাদের ন্যায্য দাবি। উপদেষ্টা পরিষদে বলেছিলাম, এ অর্থ অবহেলিত শিক্ষকদের। তাদের অবসর ভাতা না দেওয়া অনৈতিক। কিন্তু মুশকিল হলো তাদের ভাতা এক বছরের বাজেটের ওপর চাপিয়ে সমাধান করা যাবে না। আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করছি। যেমন বন্ডের মাধ্যমে একটা ফান্ড তৈরির চেষ্টা করছি, যে টাকা আসবে, সেটা থেকে শুধু আগামী বছরের জন্য নয়, বাকি রয়ে গেছে যে ৬ থেকে ৭ বছরের সেগুলোরও যাতে একটা স্থায়ী সমাধান হয়। আগামী বছর থেকে এটি শুরু হতে পারে। বাজেটের ওপর যেন অধিক চাপ না পড়ে, সেজন্য বন্ড দিচ্ছি।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বেশি বরাদ্দ : উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষা খাতে অনেক সমস্যা আছে সেগুলো এক বছরে সমাধান হবে না। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোথাও স্কুল আছে শিক্ষক নেই, কোথাও ছাত্র আছে কিন্তু দালান কোঠা ভেঙে গেছে। এ অসঙ্গতিগুলো এতদিন অপরিকল্পিতভাবে ছিল। এটা রাতারাতি ঠিক করা যাবে না। অবকাঠামোগত কিছু ঘাটতি থাকলেও যাতে শিক্ষার মান উন্নত হয়। ভালো সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে, সেদিকে চেষ্টা করব। এ জন্য আপনারা দেখবেন আগামী বছরের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে উন্নয়ন বাজেটে খুব বেশি বরাদ্দ না থাকলেও পুরো বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে আমরা চেষ্টা করব অন্য বছরের তুলনায় আনুপাতিকভাবে একটু বেশি বরাদ্দ দিতে। কারণ, অবকাঠামো তৈরি করা হলে উন্নয়ন বাজেটে চলে যায়। শিক্ষকদের কিছু সুবিধা দেওয়া হলে, সেটা রেভিনিউ বাজেটে চলে যায়।