ই-অরেঞ্জের মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার দাবি
গ্রাহকের প্রায় ৩৫৮ কোটি টাকা আত্মসাতের মানিলন্ডারিং মামলা ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ দাবি করে তা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন বহুল আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ ও পেমেন্ট গেটওয়ে সফটওয়্যার শপ লিমিটেডের (এসএসএল) কর্ণধাররা। ঢাকার জেলা প্রশাসক বরাবর করা এ আবেদন বর্তমানে ঢাকার মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে মতামতের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ায় তাদেরকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২১ সালের অক্টোবরে গুলশান থানায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ২৩২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগÑসিআইডি। মামলার এজাহারে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও বীথি আক্তার, চিফ অপারেটিং অফিসার আমান উল্লাহ চৌধুরী, উপদেষ্টা মাসুকুর রহমান, পরিচালক সাবেক পুলিশ পরিদর্শক শেখ সোহেল রানাকে আসামি করা হয়।
অভিযোগে বলা হয়Ñ ই-কমার্স ব্যবসার নামে গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে ব্যবসায়িক লেনদেনের বাইরে নগদ উত্তোলন ও ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে আসামিরা মানি লন্ডারিং করেছেন। গ্রাহকের টাকা পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাবে গ্রহণ করার পরও পণ্য সরবরাহ না করে চক্রটি প্রতারণা করেছে। ২৩২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা মানি লন্ডারিংয়ের কথা বলা হয় এজাহারে। মামলাটি তদন্তের পর ই-অরেঞ্জের অন্যতম কর্ণধার বরখাস্ত হওয়া পুলিশ পরিদর্শক শেখ সোহেল রানাসহ ১২ জনকে অভিযুক্ত করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে গত বছর সেপ্টেম্বরে আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। চার্জশিটে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩৫৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
চার্জশিটভুক্তরা হলেনÑ শেখ সোহেল রানা, তার বোন ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, সোনিয়ার স্বামী মাসুকুর রহমান, খালু মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ, ই-অরেঞ্জের আরেক মালিক বীথি আক্তার, কর্মকর্তা আমানউল্লাহ চৌধুরী, মেহেদী হাসান, নাজমুল আলম রাসেল ও মঞ্জুর আলম পারভেজ এবং সফটওয়্যার শপ লিমিটেডের (এসএসএল) চেয়ারম্যান সাবরিনা ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম ও কর্মকর্তা নূরুল হুদা। এর মধ্যে সোনিয়া, মাসুকুর, আমানুল্লাহ ও নাজমুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে সোনিয়া ও মাসুকুর কারাগারে রয়েছেন।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
গুলশান থানার এই মামলাটি (নম্বর ৬-১০-২০২১) ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রত্যাহারের আবেদনে আবেদনকারীরা মামলাটি প্রত্যাহার অথবা মামলা হতে তাদের নাম কর্তনের জন্য বলেছেন। আবেদনকারীরা হলেন সফটওয়্যার শপ লিমিটেডের মালিক সাবরিনা ইসলাম, তার স্বামী ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাইফুল ইসলাম ও চিফ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার কর্নেল মো. নুরুল হুদা (অব.)।
আবেদনে বলা হয়Ñ আবেদনকারী আসামিরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার কারণে বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল পেমেন্ট শিল্পে নিবেদিত ও সক্ষম প্রমাণিত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘সফটওয়্যার শপ লিমিটেড’কে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আইনের অপব্যবহার করে নানাবিধ ক্ষতির চেষ্টা করেছে। তারা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন না। বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় বিগত সরকারের তাঁবেদার সিআইডির তৎকালীন প্রধান (বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত) অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া ও তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছেন। তাদের শুধু রাজনৈতিক কারণে অত্র মামলার চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আবেদনে আরও বলা হয়, আবেদনকারী আসামিরা প্রতিষ্ঠান সফটওয়?্যার শপ লিমিটেড থেকে পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস নিয়েছে- এমনই একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হলো ই-অরেঞ্জ শপ। তাদের সঙ্গে আবেদনকারীদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। আবেদনকারী আসামিদের মিথ্যাভাবে মামলায় অন্তর্ভুক্তির অনুমোদন প্রদানকারী তৎকালীন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়াকে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অত্যাচারে অংশগ্রহণসহ অন্যান্য গুরুতর অভিযোগে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
এদিকে মামলার চার্জশিটে বলা হয়- পেমেন্ট গেটওয়ে এসএসএল শর্তবহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে জ্ঞাতসারে ই-অরেঞ্জ ডট শপকে প্রতারণায় সহায়তা করেছে। ই-অরেঞ্জের ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫৭০ গ্রাহকের কাছ থেকে ৯৫৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে এসএসএল। তা থেকে এসএসএল ২২ কোটি ১৩ লাখ টাকা কমিশন নিয়েছে।
মামলার পরপরই ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক ঢাকার বনানী থানার ওই সময়ের পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা ভারতে পালিয়ে যান। প্রতারণার খবর সামনে আসার পর সোহেল রানাকে বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের চাকরির আড়ালে তিনি ই-অরেঞ্জ শপ পরিচালনা করতেন। ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে দেশটিতে গ্রেপ্তার হন তিনি। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে সাজা দেন আদালত। পরে জামিন পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। তাকে ভারত থেকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়াধীন। সোহেলের বিরুদ্ধে ঢাকায় ৯টি মামলা রয়েছে।
মামলা প্রত্যাহারের মতামত দেওয়া না দেওয়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে রাজনৈতিক কারণে যেসব নাশকতার মামলা বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করেছে, সেসব মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করছি। আর দুদকের সিডিউলভুক্ত অপরাধের যেসব মামলায় আবেদন করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা কোনো মতামত দিইনি। কারণ, সেগুলো প্রত্যাহারের এখতিয়ার একমাত্র দুদকের। এর বাইরে যেসব মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করা হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক কারণে কি না, মামলা প্রমাণের পর্যাপ্ত ডকুমেন্টারি এভিডেন্স আছে কি না, তা দেখে নিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম