স্পেশাল অলিম্পিকে নীরব সাফল্য

প্রিন্স রাসেল
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
স্পেশাল অলিম্পিকে নীরব সাফল্য

শারীরিকভাবে অক্ষম নন তারা। ৮-১০টা সুস্থ-সবল সাধারণ মানুষের মতো নন। তাদের বলা হয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ এই গোষ্ঠীকে একই সুতোয় গাঁথার প্রয়াস চালাচ্ছে স্পেশাল অলিম্পিক বাংলাদেশ (এসওবি)। পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের দীর্ঘ যাত্রায় অনেকটাই সফল বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠান বা এনজিওটি। তাদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বৈশি^ক কিংবা মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। আরও একবার শুরু হতে যাচ্ছে স্বপ্নযাত্রা।

আগামী মার্চে (৮-১৬) ইতালির তুরিনে অনুষ্ঠিতব্য শীতকালীন স্পেশাল অলিম্পিক গেমসে অংশ নেবে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। এটি গেমসের ১২তম আসর হলেও বাংলাদেশের জন্য তৃতীয়। এই গেমসে ৮টি ইভেন্টের মধ্যে স্রেফ ফ্লোরবল ইভেন্টে অংশ নেবে দল। খেলাটি বাংলাদেশিদের জন্য নতুন। নিয়ম-কানুন ও খেলার ধরনে আছে ভিন্নতা। তবে ফ্লোর হকির সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে। আগের দুটি আসরের এই ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সবশেষ আসরে পুরুষ দলের স্বপ্ন ভেঙেছে ফাইনালে।

তুরিনে ফ্লোরবল ইভেন্টের জন্য ৮ ক্রীড়াবিদকে গত নভেম্বর বিভাগীয় পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করা হয়েছে। যদিও মাঠে খেলবেন ৬ জন; দুজন থাকবেন রিজার্ভ বেঞ্চে। এসব খেলোয়াড়কে নিয়ে ১৩-২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বিকেএসপিতে প্রথম দফায় ক্যাম্প হয়েছে। ইতালির উড়োজাহাজে চড়ার আগে দ্বিতীয়বার ক্যাম্প করবে বাংলাদেশ, যা শুরু হবে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি। প্রাথমিক ক্যাম্প থেকে ফ্লোরবল সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন ক্রীড়াবিদরা। বল দেওয়া-নেওয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল তাদের কার্যক্রম। গোল করা ও অন্যান্য কলাকৌশলও রপ্ত করার চেষ্টায় আছেন খেলোয়াড়রা। যত বেশি অনুশীলন, ততই হবে উন্নতি। কাজটা কঠিন। তবে আশা আছে ভালো করার। প্রত্যাশার কিছুটা বাড়তি চাপও থাকছে। ক্রীড়াবিদের প্রস্তুতি ও লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন রাজু আমাদের সময়কে বলেছেন, ‘ধীরে ধীরে ওরা উন্নতি করছে। পাসিং এবং গোল করতে আরও উন্নতি দরকার। ওরা প্রতিভাবান। যে জিনিসটা দেখানো হয়, অল্পতে করে ফেলতে পারে। আমাদের লক্ষ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া। যত বেশি অনুশীলন ততই উন্নতি হবে, আমাদের (শিরোপা জয়ের) সুযোগ থাকবে।’ ইভেন্টে মোট ১১টি দল রয়েছে। রাজু জানান, যুক্তরাষ্ট্র এবং আফ্রিকান দলগুলো আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। খেলোয়াড়দের নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন সহকারী কোচ ফরিদা ইয়াসমিন বিউটিও। কোচ-খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের মিলিয়ে বাংলাদেশের এই বহরটা হতে যাচ্ছে ১৪ জনের। বহরে নেতৃত্ব দেবেন এসওবির ক্রীড়া পরিচালক আবুল হাশেম। তার সহকারী ব্যাডমিন্টন কিংবদন্তি কামরুন্নাহার ডানা।

স্পেশাল অলিম্পিক বাংলাদেশের কার্যপরিধি বিশাল। সারাবছরে ৩০ থেকে ৪০টি কর্মসূচি থাকে তাদের। কিছু কার্যক্রম চলে বছরজুড়ে। কিন্তু সেভাবে এনজিওটি দৃশ্যপটে আসতে পেরেছে খুব কমই। এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদের নিবন্ধন করিয়েছে তারা। প্রতি বছর ১০ হাজারেরও বেশি ক্রীড়াবিদকে নিজেদের আওতায় নিয়ে আসছে তারা। বিদায়ী বছরেই এর সংখ্যাটা ছিল ১০৪০০।

মূলত মহামারী করোনাভাইরাসের পর থেকে খেলোয়াড় বাছাই প্রক্রিয়াটা কঠিন হয়ে উঠেছে। কেননা, ওই সময়টায় বিশেষ এই শ্রেণির মানুষগুলো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বিভিন্ন প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে বিশ্বজুড়ে দেশগুলোকে অনুপ্রাণিত করছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেশাল অলিম্পিক, যা কাজে লাগায় এসওবি। প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই নিজেদের যাত্রা অব্যাহত রাখে তারা।

১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ স্পেশাল অলিম্পিকের। সংস্থাটির ২৮ জন পরিচালক রয়েছেন। সবশেষ চেয়ারম্যান ছিলেন শামীম মতিন চৌধুরী। বর্তমানে চেয়ারম্যান মশিউর রহমান। ন্যাশনাল ডিরেক্টর হিসেবে সংস্থাটির সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন ফারুকুল ইসলাম। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পেশায় ছিলেন সাইকোলোজিস্ট। খুব কাছ থেকেই মিশেছেন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের সঙ্গে।

প্রতি বছর নিবন্ধিত ক্রীড়াবিদদের নিয়ে জাতীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। একজন খেলোয়াড়কে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে দরকার অনেক সময়, অর্থ, অনুশীলন ও ধৈর্য। ফিটনেস ও অনুশীলন পর্যবেক্ষণ থেকেই চূড়ান্ত করা হয় কোন ক্রীড়াবিদ কোন খেলার উপযোগী। স্পেশাল অলিম্পিক বাংলাদেশের অধীনে রয়েছে ১২টি। এসব খেলাধুলায় নিয়ে আসতে দেশজুড়ে রয়েছেন অন্তত ১০০ জন কোচ।

আরও পড়ুন:

বিপাকে আলভেস

বিশ^জুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়মিত সাফল্য পাচ্ছে বাংলাদেশ। যাদের কল্যাণে এসব সাফল্য তাদের নিয়ে গর্বিত ফারুকুল ইসলাম, ‘বিশ^জুড়ে যেসব গেমস হয়, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে আমাদের খেলোয়াড়রা চমৎকার সাফল্য এনেছে। পদক এনে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করছে। ওদের সাফল্য দেখে অনেকেই খুশি হন। দেশের জন্য ওরা যে গৌরব বয়ে আনছেÑ এটাই আমাদের আনন্দের বিষয়।’

অবশ্য আনন্দের মাঝেও কিছুটা হতাশা রয়েছে। স্বপ্নযাত্রায় বরাবরই আর্থিক সমস্যাগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সরকারের কাছে প্রতি বছর নির্ধারিত একটা বরাদ্দ চান ফারুকুল ইসলাম, ‘আমাদের ফান্ডিংয়ে খুব অসুবিধা। নিজেরা অর্থায়ন করি। আন্তর্জাতিকভাবে কিছু সহায়তা পাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে আমাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। একটা নির্ধারিত বরাদ্দ থাকলে ভালো হয়। সরকার যদি এই জায়গাটায় একটু নজর দেয়, তাহলে আমাদের কাজ আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে। এমনিতে দুই-একবার সরকারিভাবে এককালীন কিছু বরাদ্দ পাওয়া গেছে। কিন্তু নিয়মিত বরাদ্দ না থাকায় আমাদের সবার কাছে হাত পাততে হয়। আমাদের কাছে গরিব ঘরের ছেলে-মেয়েরাই আসে। উচ্চবিত্তরা খুব একটা আসে না।’