রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া অর্থনীতি এগোবে না

নিজস্ব প্রতিবেদক
৩০ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া অর্থনীতি এগোবে না

রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার এগোবে না বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির মতে, ক্ষমতার পালাবদল হলেও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য ফেরেনি, উন্নতির লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বিনিয়োগে মন্দাকাল চলছে, বাড়েনি কর্মসংস্থানও। গতকাল বুধবার (২৯ জানুয়ারি) রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫ : সংকটময় সময়ে প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এ তথ্য তুলে ধরেন।

সিপিডি বলেছে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। সংস্থাটি আরও জানায়, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী মহলকে মোকাবিলা করে সংস্কার সম্ভব নয়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও সুশাসন বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে সংস্কার টেকসই করতে হবে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল ছিল। ক্ষমতার পালাবদলের পরও গত ছয় মাসে অর্থনীতিতে তেমন চাঞ্চল্য ফেরেনি। জুলাই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল অর্থনীতি। আরও নির্দিষ্ট করে বললে কর্মসংস্থানের অভাব। পূর্ববর্তী সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে এটা আরও ঘনীভূত হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েও কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। বিনিয়োগে মন্দাকাল চলছে জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে এখন বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ। বৈদেশিক বিনিয়োগে মন্দাকাল চলছে। বিনিয়োগই নেই কর্মসংস্থান হবে কিভাবে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বেকারত্ব ছিল ৪.০৭ শতাংশ। এ বছর যা ৪.৪৯ শতাংশ হয়েছে। চলমান অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগের আত্মবিশ্বাস পাচ্ছে না। আবার সরকারের (ঋণ গ্রহণে) অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যা অর্থনীতিতে সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর বহুমাত্রিকতা বিবেচনা করে একটি ত্রিমুখী পদ্ধতি নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, যাতে তারা অর্থনৈতিক ধাক্কাটা থেকে পুনরুদ্ধারের কিছুটা অবকাশ পায়। দ্বিতীয়ত, বছরের পর বছর ধরে পুঞ্জিভূত যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো মোকাবিলা করা। তৃতীয়ত, সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোকে শক্তিশালী করার জন্য সংস্কার গ্রহণ এবং সেগুলোকে টেকসই করা।

সিপিডি মনে করে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং কার্যকরী কৌশল গ্রহণ করতে হবে যা একই সঙ্গে তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবিলা করবে এবং পরবর্তী রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়নের জন্য মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সূচনা করবে।

মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক সাত শতাংশ। গত বছর একই সময় তা ছিল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সফলতা এখনও দেখা যায়নি।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত প্রসঙ্গে বলেন, এ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জনসম্মুখে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি প্রকাশ করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব চুক্তি উন্মুক্ত করা হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ঋণের ফাঁদে রয়েছে। ঋণের দুষ্টুচক্রে আটকা পড়ে আছে। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি খাত মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে, যার জন্য মূলত পূর্ববর্তী সরকারের নীতিকাঠামো দায়ী। এই সংকট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

সিপিডি বলছে, ২০২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর্যায়ক্রমিক বন্ধের ফলে এমনটা হয়েছে। গত ছয় মাসে নতুন কোনো জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংযোজনের অগ্রগতি তেমন হয়নি।

ব্যাংক খাতও নানা সমস্যায় জর্জরিত বলে জানিয়েছে গবেষণা সংস্থাটি। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাতে নানা দুর্বলতা রয়েছে। প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ ব্যাংকের সম্পদের মান ও তারল্য পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। খেলাপি ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার বেশি। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে এ হার ৪০.৩৫ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকে ১১.৮ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি ও পণ্যমূল্যের বিষয়ে ফাহমিদা বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজি বন্ধ ও মজুতদারি বা অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়মগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মোকাবিলা করতে পারেনি। সরকার খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী ও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে পূর্ববর্তী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে একটি অকার্যকর অর্থনীতি রেখে গেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঠিক করতে হবে। বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলের বিশ্লেষণে মধ্যস্থতাকারীদের একটি জটিল নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

সংস্থাটি বলছে, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকার বেশি দিন থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায় তারা। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। আমরা চাই, সরকার ঘোষিত রোডম্যাপের মধ্যেই নির্বাচন হোক। যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।’

ব্রিফিংয়ে অন্যদের মধ্যে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা ফেলো মুনতাসির কামাল, সৈয়দ ইউসুফ সাদাতসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার এমন সময়ে ভ্যাট বাড়াচ্ছে, যে সময়ে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ এসেছিল, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।