পাচারের টাকা ফেরত আনতে সরকারের জোর তৎপরতা
দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করে কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্সের অধীনে শেখ হাসিনার পরিবারসহ শীর্ষ ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর অবৈধ অর্থ অর্জন, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার খতিয়ে দেখতে যৌথ তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া পাচারের ঘটনা তদন্ত করতে বিশ্বের বড় তিনটি অডিট ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হাসিনার টানা তিন মেয়াদের যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, তাতে দুর্নীতি ও টাকা পাচারের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। শে^তপত্র কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজার দরে (প্রতি ডলার দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই অর্থ ফেরাতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ছাড়া পাচারে সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। গতকাল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেনÑ দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয়ে যাওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে বিশ্বের বৃহৎ তিনটি হিসাবরক্ষণ ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফার্মগুলো হচ্ছে ইওয়াই, ডেলয়েট ও কেপিএমজি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ১১টি যৌথ তদন্ত দল গঠন করেছে, যারা ব্যাংক থেকে পাচারকৃত তহবিল দিয়ে কেনা সম্পদ খুঁজে বের করবে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করবে। বাংলাদেশি ১০টি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের তদন্তের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি। গত অক্টোবরে এই গণমাধ্যমকে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে গভর্নর বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে নতুন শেয়ারধারীদের ঋণ দেওয়া ও আমদানির অতিরিক্ত খরচ দেখানোর মতো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গত সেপ্টেম্বরে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করে সরকার। এতে বাড়ানো হয়েছে টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি। এত দিন কার্যপরিধিতে তিনটি বিষয় থাকলেও এবার করা হয়েছে ছয়টি। এগুলো হলোÑ পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিতকরণ ও তদন্তে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সহযোগিতা প্রদান; পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে দায়েরকৃত মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা ও তা দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ; বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার উদ্যোগ গ্রহণ; জব্দ বা উদ্ধারকৃত সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ; এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ, তথ্য আহরণ এবং পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন।
এ ছাড়া প্রথমবারের মতো এ টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। এই টাস্কফোর্স পুনর্গঠনের পর একাধিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনের তথ্য আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছেÑ প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩.৪ শতাংশ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় থেকে যত অর্থ এসেছে, এর এক-পঞ্চমাংশ পরিমাণ অর্থ এক বছরে পাচার হয়। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে যত অর্থ আসে, এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। এদিকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে টাস্কফোর্সকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন উপায়ে প্রতি বছরই অর্থ পাচার করা হয়। ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও চালান জালিয়াতি, দেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের পাঠানো অর্থ, ভিসা ও অভিবাসন, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। তবে একবার অর্থপাচার হয়ে গেলে, তা ফিরিয়ে আনা কঠিন ও দুঃসাধ্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা একটা সেøা প্রসেস। গ্লোবালি যদি দেখেন এটি খুবই সেøা প্রসেস। এর জন্য যত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের থেকে টাস্কফোর্স করে দেওয়া হয়েছে, সম্পদ পুনরুদ্ধার কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ১১টি টিম কাজ করছে। আমরা বিশ্বের বড় বড় এজেন্সির সঙ্গে কথা বলছি, যার মধ্যে কেপিএমজি অন্যতম। তাদের পরামর্শ নিচ্ছি। এটা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। কেন না, প্রফেসর ইউনূস যখনই বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন, এই বিষয় তুলছেন। এই টাকা বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের, এটা যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশে অর্থ পাচারের মতো আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হলো বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। আর্থিক এ গোয়েন্দা সংস্থাটির পক্ষ থেকেই পাচারকৃত অর্থের গতিপথসংক্রান্ত নথিপত্র চূড়ান্ত করতে হয়। এরপর সে নথিপত্রের ভিত্তিতে তদন্ত করে দুদক, এনবিআর বা সিআইডি। তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হলে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষে আদালতের রায় পাওয়ার পরই বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ তৈরি হয়। তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত অর্থ পাচার ঠেকাতে সাফল্য পায়নি সংস্থাটি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আগে অর্থ পাচারের জায়গাগুলো ট্র্যাকিং করতে হবে। সেটা করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাজ করেÑ এমন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ ছাড়া যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে। প্রয়োজনে চুক্তি করতে হবে। তবেই অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।