ধর্মীয় বিষয়ে অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে বেশি

সৈয়দ রিফাত
২৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ধর্মীয় বিষয়ে অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে বেশি

গত বছরের আগস্ট থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য প্রচার বেড়ে যায়। যা নতুন মাত্রা পায় নভেম্বরে। গত এক বছরে ছড়ানো ভুল তথ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও ইসলামি চরমপন্থা উত্থানের দাবি। এসব দাবির ক্ষেত্রে পুরোনো ও অপ্রাসঙ্গিক ছবি ও ভিডিও যুক্ত করা হয়েছিল। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। ‘২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছড়ানো ভুল তথ্যের প্রবণতা ও বয়ান’ শিরোনামে সম্প্রতি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। তারা বলছে, আগস্টের পর থেকে ধর্মীয় অপতথ্য ক্রমেই বিদ্বেষমূলক হয়ে উঠেছে, বিভাজন বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে অপতথ্য বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে। অপতথ্য ছড়াতে অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে, ভাড়া করা হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থাকে। এমনকি রাজনীতিকরা অপতথ্যকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। অপতথ্য রোধে ফ্যাক্টচেকের ওপর জোর দিচ্ছেন গবেষকরা।

ডিসমিসল্যাবের গবেষণা প্রধান মিনহাজ আমান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, তথ্যের প্রচার ও প্রসার অনলাইনে বেড়ে যাওয়ায় পাঠককে ক্রিটিক্যাাল থিংকিংয়ের চর্চা করতে হবে। যেকোনো তথ্য গ্রহণ এবং শেয়ারের আগে বিশেষ করে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উত্তেজনার সময়ে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে। বাংলাদেশে এখন পাঁচটির বেশি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সত্যতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ধর্মীয় বিষয়ের ওপর তথ্য যাচাই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরের মাসগুলোতে ধর্মসংশ্লিষ্ট ভুল তথ্য বেশি ছড়িয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং হিন্দু ধর্মানুসারীদের ‘সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটে’র মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার ও তার বিচারের প্রসঙ্গ এতে সবচেয়ে বড় প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে।

প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ধর্মীয় অপতথ্যের একটি বড় অংশে দাবি করা হয় বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বেড়েছে, বা ইসলামি চরমপন্থার উত্থান হয়েছে। কোথাও পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি ও ভিডিও দিয়ে হিন্দুদের ওপর হামলার দাবি করা হয়েছে, কোথাও মুসলিম ব্যক্তি বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার দৃশ্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হিসেবে। কোথাও বলা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিন্দুদের দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন, গণহত্যার আহ্বান

জানিয়েছেন বা বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে মিছিল করে হিন্দুদের জবাই করার হুমকি দিয়েছেন।

এক বছরে ভুল তথ্য বেড়েছে ৫৮ শতাংশ : ২০২৪ সালে বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা ফ্যাক্টচেকাররা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি ভুয়া তথ্য যাচাই করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির ফ্যাক্টচেকিং ডেটাবেস অনুযায়ী, বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা আটটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা ২০২৪ সালে সাড়ে চার হাজারের বেশি ভুয়া তথ্য যাচাই করেছে।

সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ড. ইউনূস, শেখ হাসিনা ও সাকিবকে নিয়ে : ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ছড়ানো মোট ভুল তথ্যের তিন ভাগের এক ভাগই (৩৩ শতাংশ) ছিল রাজনীতিসংক্রান্ত। এর পর ধর্মীয় বিষয়ে ভুল তথ্য ১৩ শতাংশ ও খেলাধুলা ৮ শতাংশ। এর কারণ বলা হয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেষদিকে ধর্মীয় সংঘাত। ভুল তথ্যের বিষয়বস্তু হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছিল আওয়ামী লীগ, সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও বিএনপি নিয়ে।

সবচেয়ে বেশি এসেছে ভারতের নাম : ২০২৪ সালে প্রকাশিত তথ্য-যাচাই প্রতিবেদনের শিরোনামে ভারতের নাম এসেছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সে দেশের সামাজিক মাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সম্পর্কে মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য প্রচার করেছিল বেশি। এর পর ফিলিস্তিন, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সম্পর্কিত ভুল তথ্যও ছিল।

বাদ যায়নি খেলাধুলা : প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও জুনে ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় তুলনামূলক কম ছিল। এ সময় ক্রিকেট ও ক্রিকেট-তারকা সম্পর্কিত ভুল তথ্য ছড়ানো হয়। বিশেষ করে আইপিএল-বিপিএল জড়িয়ে জুয়ার প্রচারে তারকা ক্রিকেটারদের ছবি এবং বিবৃতিও ব্যবহার করা হয়েছিল। জুনে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে তখন খেলা সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার বেড়ে যায়।