রাজনীতিতে বাড়ছে পারস্পরিক অনাস্থা

মুহম্মদ আকবর
২৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাজনীতিতে বাড়ছে পারস্পরিক অনাস্থা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে সম্প্রতি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপি মহাসচিবের মন্তব্য; এর জেরে তথ্য উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্ট এবং এরও পরে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাল্টা মন্তব্য ঘিরে চলছে নানারকম আলোচনা-পর্যালোচনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে করে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়ায় যে ফাটল রয়েছে, সেটি আরও স্পষ্ট হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারের সহযোগিতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে বলে যে গুঞ্জন চলছে, সেই গুঞ্জন এই ফাটলকে আরও বড় করছে। বিশ্লেষকদের মতে, হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সম্প্রতি একধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং এক দলের সঙ্গে অন্য দলের পারস্পরিক অবিশ^াস, অনাস্থা বাড়ছে।

বিএনপিসহ বেশকিছু দল যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের ওপর বরাবরই গুরুত্বারোপ করে আসছে। এ বিষয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে দাভোসে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জানান, নির্বাচনের সময়কাল নির্ভর করবে দেশের জনগণের প্রত্যাশার ওপর। মানুষ যদি দ্রুত সংস্কার চায়, তাহলে আমরা এ বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েছি। আর যদি বলে, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার দরকার, তাহলে আমাদের আরও ছয় মাস সময় লাগবে।

সরকারের ভেতর থেকে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা হলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, যদি ছাত্ররা সরকারের ভেতরে থেকে দল গঠন করে, তাহলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠবে। ছাত্ররা দল গঠন করবে, খুবই ভালো কথা। আমরা তারুণ্যের শক্তিকে স্বাগত জানাব। কিন্তু কিংস পার্টি গঠন হলে ছাত্রদের আদর্শটা থাকে না। এটা হবে খুবই অপ্রত্যাশিত। এতে পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাবে এবং ক্ষতি হবে এই অভ্যুত্থানের।

দিলারা চৌধুরীর ভাষ্য, দল গঠন করলে আগে তাদের সরকার থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তারা অভ্যুত্থান করেছে খুব ভালো কথা। আমিও এই অভ্যুত্থানে ছাত্রদের সঙ্গে অনেক কর্মসূচিতে ছিলাম, এখনও তাদের সঙ্গেই আছি। কিন্তু সরকারে থেকে নতুন পার্টি গঠন করলে অভ্যুত্থানের আদর্শ নষ্ট হবে।

নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধ আরও স্পষ্ট হতে থাকবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিরোধগুলোও তত স্পষ্ট হতে থাকবে। যার-যার স্বার্থের বিষয়ে রাখঢাক সরে যাবে। বিএনপি যদি দেখে, সামনের নির্বাচনে ছাত্ররা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাহলে তারা ছাত্রদের ছাড় দেবে না। এটাই স্বাভাবিক। এটাই রাজনীতি। অন্যদিকে ছাত্ররাও দেখছে, তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বিএনপি। তাই তারা বিএনপির ব্যাপারে কথা বলছে। সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, এক্ষেত্রে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। তার এ আশঙ্কার সঙ্গে আমি একমত। আমি মনে করি, এ সরকার সামনের দিনগুলোতে নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে না পারলে নির্বাচন আয়োজনের যোগ্যতা হারাবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এ সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্দলীয়। এটি সাময়িক একটা সরকার। ফলে বিশেষ কোনো দল, আদর্শ বা গ্রুপের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ তাদের নেই। যদি দেখা যায়, বিশেষ কোনো মহল, ছাত্র, দল বা গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন থাকে, তাহলে সরকারের নিরপেক্ষ চরিত্র থাকবে না। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠবে। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা দূরত্ব সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার সরকারের।

সাইফুল হক বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, গাছেরটা খাও আবার নিচেরটাও কুড়িয়ে নাওÑ এমন সুযোগ নেওয়া ঠিক হবে না। এতে সরকারের প্রতি আস্থা-বিশ^াস কমে যাবে এবং তরুণ প্রজন্মের মনে ছাত্রদের সম্পর্কে যে সম্ভাবনার স্বপ্ন রয়েছে, শুরুতেই তা হোঁচট খাবে। তিনি যোগ করেন, সম্প্রতি ছাত্রদের মুখের ভাষা, শরীরের ভাষা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দম্ভ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তরুণদের কথাবার্তায় প্রজ্ঞার পরিচয় প্রত্যাশা করেন এই রাজনীতিক। এও বলেন যে, কোনোভাবেই চাইব না ছাত্রদের সঙ্গে, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বেড়ে যাক।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার দরকার। সুতরাং অল্প ও বেশি সংস্কার নিয়ে আলোচনা করাটা অবান্তর। সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে আগামী ৭-৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব, মন্তব্য তার।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বিএনপি মহাসচিব বলেছেন সরকারের নিরপেক্ষতা যদি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে তারা নিরপেক্ষ সরকারের দাবি তুলবেন। অপরদিকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, সরকারের কেউ যদি রাজনৈতিক দলে যুক্ত হয় তাহলে তিনি সরকারে থাকবেন না; পদত্যাগ করবেন। এখানে তো আমি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের কোনো বিরোধ দেখি না।

মঞ্জু বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারীরা যেহেতু একটা দল গঠনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেটা নিয়ে একটু তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। আমি এটাকে গণতান্ত্রিক চর্চার ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখি। তিনি বলেন, বিএনপি হলো বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী সবচেয়ে বড় দল, মির্জা ফখরুল সেই দলের অন্যতম শীর্ষজন। আর উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের অন্যতম প্রধান নেতা। ফ্যাসিবাদের পতনের পর এই দুজন, তাদের কমিউনিটি বা দল সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার কেন্দ্রে। তাই অল্পস্বল্প দ্বিমত থাকতেই পারে, বিতর্কও হতে পারে। এমন বিতর্কের কারণে আপাতদৃষ্টিতে উভয়পক্ষের মধ্যে একটু দূরত্ব বা উদ্বেগ তৈরি হলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ বা অনৈক্য হবে না বলেই আমি মনে করি।