জিয়াউল আহসানের অঢেল সম্পদ
ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক ও বরখাস্ত হওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৩৪২ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন ঢাকার সেগুনবাগিচায় সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, আসামি মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান নিজ নামে ২২ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ১৪২ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন। তিনি গাইডলাইন অব ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রান্সজেকশন-২০১৮ লঙ্ঘন করে নিজ হিসাবে ৫৫ হাজার ডলার জমা করেন। স্ত্রী নুসরাত জাহানের সহযোগিতায় বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করেছেন। তার নামীয় ৮টি সক্রিয় ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১২০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ মামলায় স্ত্রী নুসরাতকেও আসামি করা হয়েছে।
অন্যদিকে অপর মামলায় তার স্ত্রী নুসরাত জাহানের নামে ১৮ কোটি ৫৯ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৮ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
তার নামীয় চারটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২২২ কোটি ৫০ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা, দ-বিধি ১৮৬০-এর ১০৯ ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২), ৪(৩) ধারায় পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, অনুসন্ধানে জিয়াউল আহসানের নামে একটি বাগানবাড়ি, ৫টি বাড়ি (ঢাকায় ১টি আটতলা, বরিশালে ১টি আটতলা, ঝালকাঠিতে ১টি), ৩টি ফ্ল্যাট এবং ৩ হাজার ৩৩৩.৫১ শতাংশ জমি রয়েছে। এ ছাড়া ২টি হার্ড জিপ গাড়ি, শেয়ারবাজারে প্রায় ৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্রে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তার স্ত্রী নুসরাত জাহানের নামে ১৬৪.৯১ শতাংশ প্লট জমি, সঞ্চয়পত্রে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।
জিয়াউল আহসান ২০১৭ সাল থেকে ট্যাক্স হেভেন খ্যাত এন্টিগুয়া অ্যান্ড বার্বুডা নামের দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন এবং সেখানে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া দুবাইতে ৯৫ কোটি টাকা ও মালয়েশিয়ায় ৭৫ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া জিয়াউল আহসান তার বাবার নামে বরিশালে ‘নাসির উদ্দিন-ই-এতিমখানা’ নামে একটি ট্রাস্ট স্থাপন করেছেন। দুদক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই এতিমখানার নামে বরিশালের ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডে একটি সঞ্চয়ী হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তিন কোটির বেশি টাকা জমা ও সমপরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হয়। এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও ব্যবসায়িক এজেন্টদের ওই ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা দেওয়ার প্রমাণও মিলেছে, যা সন্দেহজনক বলে মনে করা হচ্ছে। আসামি জিয়াউল আহসান পেশায় উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তা হওয়ায় ভয়-ভীতি প্রদর্শন বা বিধিবহির্ভূতভাবে প্রাপ্ত অর্থ ওই এতিমখানার নামে গ্রহণ করে থাকতে পারেন বলে অনুমান করা হচ্ছে।
দুদকের অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, চাকরিজীবনে জিয়াউল আহসান মোট ২ কোটি ১৬ লাখ ২২ হাজার ৫৭৫ টাকা নিট আয় করেছেন। তবে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শিত সম্পদের বিপরীতে বৈধ আয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কারণ তার নামে কোনো মৎস্য বা পোলট্রি খামারের অস্তিত্ব মেলেনি এবং কৃষিজমির আয় সম্পর্কেও বৈধ রেকর্ড নেই। ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার তার হিসাবে নিয়মিত অর্থ জমা হতো, যা থেকে স্ত্রী নুসরাত জাহান এবং বোন নাজমুন নাহার অপু, নাজনীন নাহার দিপু, লুৎফুন নাহার পাখি, শামসুন নাহার ও নাসরিন নাহারের কাছে টাকা পাঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংকের এক হিসাবে স্ত্রীর বড় ভাই মো. শফিকুল হক, স্ত্রীর আরেক ভাই তারিফুর রহমানসহ একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে ২৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা জমার তথ্য মিলেছে।
দুদকের অনুসন্ধান টিম গত ১৮ ডিসেম্বর ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ ও অর্থপাচারের অভিযোগে সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। এর আগে গত ১৯ আগস্ট গুম-খুনের ‘মাস্টারমাইন্ড’, ফোনকলে আড়িপাতা, মানুষের ব্যক্তিগত আলাপ রেকর্ড ও ফাঁস করা জিয়াউল আহসান ও তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৯৯১ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া জিয়াউল র্যাব ২-এর উপ-অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক হন। র্যাবে দায়িত্ব পালনের সময় থেকেই জিয়াউল আহসান হয়ে উঠেছিলেন গণমাধ্যমে পরিচিত নাম। ২০১৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়ে এনএসআইয়ের পরিচালক হন এবং ২০২২ সালে এনটিএমসির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন