ট্রাম্পের উত্থান ও গাজার শান্তিচুক্তি ভাবনা-দুর্ভাবনা

আবুল মোমেন
২১ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ট্রাম্পের উত্থান ও গাজার শান্তিচুক্তি  ভাবনা-দুর্ভাবনা

বিশে^ দুটি বড় ঘটনা ঘটেছে দুদিনের ব্যবধানে- রবিবার থেকে কার্যকর হয়েছে গাজায় যুদ্ধবিরতি আর সোমবার ৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন রিপাবলিকান দলের বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গাজায় যুদ্ধবিরতি ছিল বিশে^র শান্তিকামী মানুষের আকাক্সক্ষার বিষয়। তবে এ কথা বলা যাবে না ট্রাম্পের অভিষেক সম্পর্কে। এ কথাও বলা যায়, দুটি ঘটনার ভবিষ্যৎ নিয়ে শান্তিকামী বিশ^বাসীর শঙ্কা ও উদ্বেগ থাকবে একইরকম।

কারণ গাজায় পনেরো মাস ধরে একতরফা হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনাকারী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেমন, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি কতটা অনির্ভরযোগ্য খামখেয়ালি স্বভাবের মানুষ। আবার এ দুজনের সখ্যও সর্বজনবিদিত। আপাতত ট্রাম্পেরই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নেতানিয়াহু। কেননা শান্তি স্থাপনের জন্য ঠিক হুবহু এবারের প্রস্তাবই কয়েক মাস আগে বাইডেন প্রশাসনের তরফ থেকে উত্থাপিত হয়েছিল,

কিন্তু তখন সেটি মেনে শান্তি স্থাপনে রাজি হননি নেতানিয়াহু। তিনি এখনও বলে রেখেছেন, হামাসের তরফে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হলে তিনি তৎক্ষণাৎ গাজায় সামরিক হামলা আবারও শুরু করবেন। সবাই জানেন অজুহাত খুঁজে নিতে নেতানিয়াহু ও তার যুদ্ধবাজ সঙ্গীদের একটুও দেরি হবে না, বাস্তব কোনো দৃষ্টান্তের প্রয়োজনও তাদের হয় না। প্রয়োজন নির্ধারিত হবে একমাত্র নিজেদের অর্থাৎ ইসরায়েলের স্বার্থের প্রয়োজন বুঝে।

আপাতত ট্রাম্প চাইছেন একজন শান্তিকামী নেতার ভাবমূর্তি নিয়ে তিনি ক্ষমতায় আসবেন এবং দ্রুত গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা করে বিশ^বাসীকে এমন বার্তা দেবেন যে, তার সম্পর্কে তাদের ধারণা কতটা ভুল। আবার তাকে নিয়ে আশঙ্কার কারণও এখানেই- ট্রাম্প একজন আনপ্রেডিক্টেব্ল বা অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, তাকে নিয়ে পূর্ব অনুমান চলে না। ফলে মার্কিন উদ্যোগে গাজায় যুদ্ধবিরতি হলেও যুদ্ধ ও শান্তি উভয়ের লাগামই যুক্তরাষ্ট্র ও তার অন্তরঙ্গ মিত্র ইসরায়েলেরই হাতে থাকবে। প্যালেস্টাইন বা তাদের পক্ষে অন্য কারও উদ্যোগী ভূমিকার সুযোগ যে থাকবে না তা নিশ্চিত। এই শান্তিকালে কি গাজায় গত পনেরো মাসে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ হত্যার- যার ৭০ শতাংশই হল নারী ও শিশু- দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে সত্যিই নেতানিয়াহু ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের শাস্তির বিধান করা যাবে?

প্রশ্ন তোলার অর্থাৎ সংশয় প্রকাশের কারণ সংশ্লিষ্ট দুই নেতার নাম ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু। তারা উভয়েই ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, নিরাপত্তার অগ্রাধিকার নিয়ে একমত, এটা তাদের যৌথ স্বার্থ। এতে আপত্তি নেই, কিন্তু অস্পষ্টতা রয়েছে ইসরায়েল এবং জায়নবাদীদের সম্প্রসারণবাদী চিন্তা নিয়ে। এ বিষয়ে নেতানিয়াহু ও কট্টর ইহুদি গোষ্ঠীর আগ্রাসী মনোভাব কারও অজানা নয়। তারা চায় পুরো প্যালেস্টাইনের দখল। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প তার চার বছরে উগ্র ইহুদিদের এ কাজে কি সমর্থন জোগাবেন? তার তো আর জনসমর্থনের তোয়াক্কা করার প্রয়োজন নেই, কারণ মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী তার তো আরেকবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই। তাকে যারা বোঝেন এমন রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা প্রায় সবাই একমত যে, আগামী চারটি বছর হবে অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা-দুর্ঘটনায় ভরপুর।

ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই প্রায় সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীকে ঝেঁটিয়ে বিদায়ের কাজ শুরুর হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশক ধরে বাস করছেন, তাদের সন্তানরা জন্মসূত্রে দেশটির বৈধ নাগরিক এবং তারা সবাই কর্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জীবনযাত্রা সচল রাখা ও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। ফলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা ট্রাম্প সত্যিই এ রকম কাজ শুরু করলে সারাদেশে ব্যাপক অশান্তি হবে, অনেক ধরনের আইনি যুদ্ধও শুরু হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তবে সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হলো এই প্রথম আমেরিকান গণতন্ত্রের ঐতিহ্যবাহী চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা প্রায় অনুপস্থিত হয়ে পড়েছে। আইনসভার দুই কক্ষ- প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট উভয়টিতেই রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে- আগের বারে যা ছিল না। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টেও ট্রাম্প অনুসারী বিচারকদের পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে। ফলে ট্রাম্প একদিকে ইচ্ছানুযায়ী আইন প্রণয়ন এবং বিল পাস করতে পারবেন, অন্যদিকে তার ভিত্তিতে গৃহীত সব কাজের পরিবেক্ষণ মূল্যায়ন ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। আরও দেখার বিষয় হবে, ট্রাম্পের পুনরায় আমেরিকাকে মহৎ বানানোর প্রক্রিয়ায় যে উগ্র শে^তাঙ্গ জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটবে তা মার্কিন রাষ্ট্র ও সমাজে কী ধরনের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ভালো কিছুর চেয়ে মন্দ কিছুর আশঙ্কাই বাড়ছে সবার মধ্যে।

এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, যে ঘটনা সোমবার ঘটেছে এবং যে ঘটনা আজ ঘটতে চলেছে তাতে গাজা নিয়ে যে স্বস্তি তাকে ছাপিয়ে শঙ্কাই মাথায় থাকবে বেশি। আবার যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলকে কেবল তাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনা হিসেবে দেখারও সুযোগ নেই। কারণ ট্রাম্প যেমন নিজ দেশে অনেক ভাঙচুর ঘটাবেন, তেমনি বিশ^ব্যবস্থাতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলার মতো কাজ করবেন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ তার একটি বড় এজেন্ডা, মধ্যপ্রাচ্য পুনর্গঠনেও তিনি উৎসাহী হতে পারেন। গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খাল নিয়ে তার সা¤্রাজ্যবাদী নকশাও জনসমক্ষে হাজির করেছেন ক্ষমতায় বসার আগেই। তার আস্তিনের ভাঁজে আরও কী কী তাস রয়েছে তা হয়তো ২০ জানুয়ারির পরে ধীরে ধীরে বোঝা যাবে। ফলে শঙ্কা ঝেড়ে ফেলার কোনো উপায় থাকছে না।

আপাতত নরকে পরিণত হওয়া গাজায় মানববসতির উপযোগী পরিবেশ ফিরে আসুক এটাই সবার প্রার্থনা। সেই সঙ্গে অবশ্যই প্যালেস্টাইন সমস্যার স্থায়ী সমাধান আয়োজন জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেবল আরব বা মুসলিম দেশের এজেন্ডা এটা হতে পারে না, এটা হতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশে^র সব শান্তিকামী দেশের এবং জাতিসংঘসহ সব বৈশি^ক ও আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং মানবিক সংস্থার জরুরি এজেন্ডা। অন্তত সবাই মিলে স্থায়ী শান্তির পক্ষে এমন আওয়াজ তোলা ও প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের ইস্যু এতটাই প্রাসঙ্গিক রাখা দরকার যাতে নেতানিয়াহুর মতো মানুষদের ভূমিকা পাল্টানো সম্ভব না হয়, যেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের ইসরায়েলের প্রতি নির্লজ্জ সমর্থন আর কখনও বাস্তবে ঘটতে না পারে। একমাত্র এভাবেই একজন ট্রাম্প বা একজন নেতানিয়াহুর ভয়ঙ্কর ভূমিকা নস্যাৎ করা সম্ভব হবে।

যেভাবেই হোক পৃথিবীকে মানবিক করে তোলার প্রয়াসের কোনো বিকল্প নেই। গাজার শান্তি স্থায়ী হোক, মানবতার চেতনা দিনে দিনে ভাস্বর হোক।

আবুল মোমেন : কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়