বাড়তি ভ্যাট ও মহার্ঘ ভাতা নিয়ে জনমনে অসন্তোষ

মূল্যস্ফীতির ওপর বড় প্রভাব ফেলবে

আবু আলী ও রেজাউল রেজা
২০ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বাড়তি ভ্যাট ও মহার্ঘ ভাতা নিয়ে জনমনে অসন্তোষ

অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বা সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি (এসডি) বাড়িয়ে দেওয়ায় বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েন্ট অর্থাৎ আগে থেকেই নিয়ম মেনে ভ্যাট আদায় করে আসছিল, তারা বর্ধিত ভ্যাট আদায় শুরু করেছে। এতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় সাধারণ মানুষের খরচের চাপ বেড়েছে। যার প্রভাবে মূল্যস্ফীতির পারদ ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এতে মূল্যস্ফীতি আরও একধাপ উসকে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থ বিভাগ বলছে, ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীকে মূল বেতনের সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর জন্য এক বছরে সরকারের বাড়তি খরচ হবে অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বাড়তি ব্যয় যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের শাসনামলে অলিগার্কদের শাসনে স্বজনতোষী অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। সে অবস্থায় সর্বব্যাপী সংকট থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে জুলাই-আগস্টে সর্বস্তরের মানুষ ছাত্রদের ডাকে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাদের আত্মত্যাগে রচিত হয় অনন্য এক ইতিহাস। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ মাসের মাথায়ই সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন (মহার্ঘ ভাতা) বাড়াতে যাচ্ছে। এটাকে খুবই যৌক্তিক বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সরকারের এ সিদ্ধান্তে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে।

ঠেলাগাড়িচালক বুলবুল আহমেদ থাকেন পুরান ঢাকার বংশালে। তিনি বলেন, শুনলাম সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়বে। তা হলে আমাদের ঠেলার ভাড়াও কি বাড়বে? না হলে তো আমরা আর বাঁচতে পারব না। এমনিতেই মাছ-মাংস কেনা বন্ধ। বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ওষ্ঠাগত প্রাণ। এর মধ্যে সরকারের বিভিন্ন নীতির ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ছে। অথচ মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে নজর দেওয়া দরকার।

এদিকে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সহজ রাস্তায় হেঁটে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চলমান পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দিলে তা ‘নিঃসন্দেহে সমস্যা সৃষ্টি করবে’ বলে মনে করেন তিনি। জনগণের ওপর পরোক্ষ কর আরোপের মতো ‘অপরিণামদর্শী’ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান রেখে বাজেট ঘাটতি পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে খরচ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

রাজস্ব আদায় বাড়াতে অসময়ে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকার। যদিও পরে দু-একটি পণ্যের ব্যাপারে ভ্যাট পর্যালোচনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপে অর্থবছর শেষে সরকারের কোষাগারে অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা জমা হবে। যদিও এটা করা হয়েছে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে। অবশ্য করজাল বিস্তৃত করার মাধ্যমে রাজস্ব বাড়াতে বলেছিল আইএমএফ।

সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ে ঠিক। কিন্তু সরকারের এখন টাকার প্রয়োজন। হয় সরকারকে ঋণ করতে হবে, নয়তো রাজস্ব বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার চেয়ে কর বাড়িয়ে অর্থ সংগ্রহ উত্তম। তার পরও এটি মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়াবে। অন্যদিকে মহার্ঘ ভাতা বাড়ানো হলে তা বাজারে চাপ তৈরি করতে পারে। কারণ এর ফলে বাজারে চাহিদা বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়তে পারে।

তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা দেখেছি, ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া হবে না এমনটা বলা হয়েছিল। কিন্তু কথা রক্ষিত হচ্ছে না। তাই অচিরেই যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে তা বলা যাবে না।

যেসব কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে তার মধ্যে ভুল নীতিও রয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির আগুন নেভাতে গিয়ে পানির পরিবর্তে তেল ঢালা হয়েছে। যার কারণে এটি সহনীয় পর্যায়ে আসেনি।