৮ মাসের সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে কাউসারের স্ত্রী
দুই আবাসন প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বের বলি নিরাপত্তাকর্মী
‘বাসায় বাজার দিয়া বাইরে যাওনের সময় দরজার সামনে উষ্টা খাইতেই কইলজাটায় মোচড় মাড়ছিল। কইলাম জিরায় যান। হুনলো না। কইলো- কিচ্ছু হইবো না, তাড়াতাড়ি রান্না শেষ কইরা ফোন দিও, আইস্যা সবাই একসাথে খামু। রান্না শেষ কইরা ফোন তো দিলাম, কিন্তু মানুষটা তো আর খাইতে পারলো না। আইলো ঠিকই, কিন্তু লাশ হইয়্যা। কী দোষ ছিল আমার স্বামীর? কেন তারে এমনে কোপাইয়্যা মারলো পশুগুলা।’ বিলাপ করে কথাগুলো বলার সময় কণ্ঠ ধরে আসছিল তামান্না আক্তার বৃষ্টির।
একটু থেমে ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে আবারও বলেন, ‘কারিবা (৯ মাসের মেয়ে) এদিক-সেদিক খালি বাবারে খোঁজে, কান্নাকাটি করে। কিন্তু ওরে কেমনে বুঝামু, তোর বাপ আর আইবো না। কারিবার বাবার টাকায় চলতো সংসার। আমাদের অথৈ সাগরে ফালাইয়্যা মানুষটা চইল্লা গেল। এহন, হেরে ছাড়া আমরা কেমনে থাকমু? চলমু কেমনে? আমার দুধের বাচ্চাটারে যারা এতিম করল তাদের বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর খিলক্ষেত থানার বরুয়া উত্তরপাড়ার দেওয়ান বাড়িতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন আবাসন প্রতিষ্ঠান স্বদেশ প্রপার্টিজের নিরাপত্তারক্ষী নিহত কাউসার দেওয়ানের স্ত্রী তামান্না আক্তার। এ সময় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল ৯ মাসের ছোট্ট শিশু কারিবা। মায়ের কান্না দেখে সেও কান্না জুড়ে দেয় কোলে বসে। শিশুটি এখনও জানে না তার বাবা আর ফিরবে না; তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন না-ফেরার দেশে, সব কিছুর ঊর্র্ধ্বে।
গত সোমবার দুপুরে দুই আবাসন প্রতিষ্ঠানের (আশিয়ান সিটি ও স্বদেশ প্রপার্টিজ) জমি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনায় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি কোপে নিহত হন কাউসার দেওয়ান। নৃশংস এই হামলার ঘটনায় দুই আবাসন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে স্বদেশ প্রপার্টিজের আরেক নিরাপত্তাকর্মী কবির দেওয়ানের অবস্থা গুরুতর। সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের কোপে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হওয়া ছাড়াও কেটে গেছে তার ঘাড়ের রগ; হাত থেকে খসে পড়েছে দুই আঙুল। তিনি হাসপাতালের বিছানায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চিকিৎসাধীন। পাল্টা হামলায় আহত আশিয়ান সিটির মালামাল সরবরাহকারী ফাহিম ভূঁইয়া এবং প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী জিহাদের অবস্থাও গুরুতর।
জমি নিয়ে দুই আবাসন প্রতিষ্ঠানের (আশিয়ান সিটি ও স্বদেশ প্রপার্টিজ) দ্বন্দ্বের জেরে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। কাউসার দেওয়ান নিহতের ঘটনায় আশিয়ান সিটির চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামি করে নিহত কাউসার দেওয়ানের বোন মোর্শেদা আক্তার গত মঙ্গলবার ৪৬ জনের বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- আশিয়ান গ্রুপের পরিচালক (ক্রয়) জাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া, আশিয়ান গ্রুপের ডিএমডি সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া, আসিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পিডি জহির উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন দেওয়ান, জামাই আনোয়ার, ফাহিম ইসলাম ভূঁইয়া, জিহাদ, মো. হৃদয় রাজ, মো. রায়হান মোল্লা, আবির হোসেন, মো. রানা রাজ, সৌভর হাসান ভূঁইয়াসহ অচেনা আরও ৩০ জন। আর গত শুক্রবার বাদী হয়ে একই থানায় স্বদেশ প্রপার্টিজের কয়েকজনের নামসহ শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন আহত জিহাদের মা জাহানারা ইসলাম। কাউসার দেওয়ান হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আনোয়ার দেওয়ান নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করলেও ঘটনার ৫ দিনেও অভিযুক্ত আর কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
গতকাল শনিবার নিহতের বাড়ির পাশে কাউসার দেওয়ানের জন্য আয়োজিত দোয়া মাহফিলে আসা হাজারো মুসল্লি ও এলাকাবাসী খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। অন্যদিকে আহত জিহাদের মা জাহানারা ইসলামের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্তদেরও গতকাল শনিবার রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
নিহত কাউসার দেওয়ানের চাচাতো ভাই মোবারক হোসেন দেওয়ান জানান, নিহত কাউসার দেওয়ান ও আহত কবির দেওয়ান দুজন স্বদেশ প্রোপার্টিজের নিরাপত্তাকর্মী। বরুয়া এলাকায় একটি ফাঁকা জায়গায় বালু ভরাটের কাজ চলছে। গত রবিবার বিকালে সেখানে আশিয়ান সিটির লোকজন এসে বালুর বস্তাগুলো নষ্ট করে দেয়। সোমবার আবার ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল জায়গা দখল করতে আসে। এ সময় কাউসার ও কবির বাধা দিলে তাদের কুপিয়ে আহত করে আশিয়ান সিটির সন্ত্রাসী বাহিনী।
কাউসার দেওয়ান হত্যা মামলার বাদী মোর্শেদা আক্তার বলেন, আমার ভাই কাউসার দেওয়ান স্বদেশ প্রপার্টিজ লিমিটেডের স্বর্ণালি আবাসন প্রকল্পে অস্থায়ী সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সোমবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে খিলক্ষেত থানাধীন বরুয়া উত্তরপাড়া বালু মাঠে গিয়ে কাউসার ও কবির দেওয়ানকে গুরুতর আহত রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখি। স্থানীয়দের সহায়তায় তাদের বসুন্ধরা এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়ার পথে কাউসার বলেন, ‘আসিয়ানের নজরুল আমাকে বাঁচতে দিল না।’
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
আহত কবির বলেন, স্বদেশ প্রপার্টিজ লিমিটেডের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত থাকায় আশিয়ান গ্রুপের মালিক ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের হত্যার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। আশিয়ানের লোকজন কাউসার ও কবিরসহ উপস্থিত নিরপত্তাকর্মীদের রামদা-চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায়। এতে কাউসার ও কবির মারা গেছে ভেবে তাদের মাঠে ফেলে যায় সন্ত্রাসীরা। পরে আমার ভাইকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক কাউসারকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুই বছর আগে বৃষ্টির সঙ্গে কাউসারের বিয়ে হয়। তাদের ঘরে ৯ মাসের একটি মেয়ে রয়েছে। এখন তাদের কী হবে। এ ঘটনায় জড়িত প্রধান আসামিদের পুলিশ এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অথচ আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে। খুনিদের গ্রেপ্তার করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন মোর্শেদা আক্তার।
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে গতকাল রাতে আশিয়ান সিটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ভূঁঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, যিনি মারা গিয়েছেন আর যিনি তাকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে- তারা মামাতো-ফুফাতো ভাই। জমি নিয়ে তাদের মধ্যে মামলা চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। এর জের ধরে তাদের মধ্যে ওই হামলা পাল্টাহামলার ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। এ ঘটনার সঙ্গে আশিয়ার সিটির কারোরই সম্পৃক্ততা নেই। অথচ একটি অসাধু মহল প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে, যা পুলিশের সত্য তদন্তে উঠে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
দুই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খিলক্ষেত থানার এসআই জসিম উদ্দিন ফরহাদ গতকাল রাতে আমাদের সময়কে বলেন, গত সোমবার দুপুরে বরুয়া এলাকায় হামলা পাল্টাহামলার ঘটনায় পৃথক দুটি (হত্যা ও হত্যাচেষ্টা) মামলা হয়েছে। হত্যা মামলায় অভিযুক্ত এক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুই মামলায় পলাতক অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। কী কারণে এই সংঘর্ষ তদন্তের পর তা জানা যাবে।