ঘোষণাপত্র প্রণয়নে একমত সব দল, আরও আলোচনা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের এক বৈঠকে এই ঐকমত্য হয়েছে বলে সব পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, জেএসডি, গণ-সংহতি আন্দোলন, বাসদ, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এবি পার্টি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণ-অধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সব পক্ষের অবদান স্বীকার করে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে সর্বদলীয় এই বৈঠক আহ্বান করেছিল সরকার। বৈঠকে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে আরও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার বিষয়েও কথা হয়েছে।
বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়ের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। সবাই বলেছেন- এ ধরনের একটা ঘোষণাপত্র করার প্রয়োজন আছে।’ তিনি বলেন, বৈঠকে অনেক মতামত এসেছে। মোটা দাগে ঘোষণাপত্রে সবার অবদান বলতে হবে, ধারাবাহিকতা উল্লেখ করতে হবে। ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক ও আইনগত ভিত্তি কী হবে, সেটা স্পষ্ট করতে হবে।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ও ছাত্র-জনতাসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে এই ঘোষণপত্র প্রণয়ন করতে হবে। এটার জন্য যত সময় প্রয়োজন, সময় নেওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো এ-ও বলেছে, অযথা কালবিলম্ব যেন না হয়। সবাই একমত হয়েছে আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এই ধরনের ঘোষণাপত্র হওয়া উচিত। সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এই প্রক্রিয়ায় আমরা সফল হব। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবাই একত্রিতভাবে ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছি, তেমনি সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এই ঘোষণাপত্র তৈরি করতে পারব।’
সময়সীমা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে আইন
উপদেষ্টা বলেন, সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্রদের সংগঠনের যারা অংশ নিয়েছে সবাই বলেছে- ঐকমত্য পোষণ করে সর্বোসম্মতিক্রমে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করার জন্য। যত সময় লাগুক, তা যেন নেওয়া হয়। তাড়াহুড়া যেন না করা হয়। অযথা কালক্ষেপণও না করা হয়। এই লক্ষ্য অনেকে প্রস্তাব করেছে আলোচনা করে একটি কমিটি গঠন করার জন্য। এই প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। আরও আলোচনা হবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলোচনা হতে পারে। কমিটি হতে পারে। সবার মতামত নিয়ে দ্রুত একটা কর্মকৌশল ঠিক করা হবে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিএনপি : আলোচনায় অংশ নেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রশ্ন করেছি যে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র আসলেই সাড়ে ৫ মাস পর কোনো প্রয়োজন আছে কি না? যদি থাকে সেটার রাজনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আইনি গুরুত্ব কী; সেটা নির্ধারণ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে যেন কোনো ফাটল সৃষ্টি না হয়। সেখানেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’ তিনি জানান, ঘোষণাপত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সবার পরামর্শ নেওয়ার জন্য তিনি প্রধান উপদেষ্টা ও সব উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেচেন।
জামায়াত : জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার বলেন, ‘মোটা দাগে বলতে পারি, প্রত্যেকটি দল একটা ঘোষণাপত্র হওয়া প্রয়োজন- সেটা অনুভব করেছে, তবে তাড়াহুড়া করে নয়। তাড়াহুড়া করলে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এ জন্য সময় নিতে হবে। রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের জন-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে, অভ্যুত্থানের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাসসহ সবকিছু মিলিয়ে একটা সুলিখিত ঘোষণাপত্র কীভাবে তৈরি করা যায়, সে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বেশি বিলম্ব হলে ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ পেতে পারে। সেই সুযোগ যাতে কেউ না পায়। তাই দেরি না করে এই উদ্যোগ শুরু করা উচিত।
নাগরিক কমিটি : সব রাজনৈতিক দল একমত বলে জানান জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দ্রুত সময়ের মধ্যে কিছু পর্যালোচনাসহ প্রকাশ হবে। এর মধ্যে কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত ও শাব্দিক চয়নে সবার আলোচনার প্রয়োজন। সেটার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার কাছে সময় চেয়েছেন। তিনি দলগুলোর সময়ক্ষেপণের বিষয়ে লক্ষ রাখতে বলেছেন, যাতে কালবিলম্বও না হয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণ হতে এ দলিল ছাড়া সম্ভন নয় বলে মনে করেন নাসিরুদ্দীন। আলটিমেটাম দিয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা সবাই একটা পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে রয়েছি। আলটিমেটামের কথা এসেছিল; কিন্তু নির্দিষ্ট করে আলটিমেটাম হয়নি। তবে এটা সম্মত হয়েছি দেরিও নয়, আবার তাড়াহুড়া নয়, দ্রুত সময়ের মধ্যে পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রকাশ করা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন : এর সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজন মিলে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করা হবে, এটা এখন নিশ্চিত। পরবর্তী ধাপে আলোচনা হবে ঘোষণাপত্রে কী কী থাকবে।
এবি পার্টি : দলের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ঘোষণাপত্র নিয়ে আমরা একটি লিখিত পরামর্শ দিয়েছি। ঐতিহাসিক দলিল তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানানো হয়। তিনি বলেন, ঘোষণাপত্র তৈরিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা অন্য কোনো কমিটি বা কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে দেওয়া হয়েছে।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম : দলটির সহ-সভাপতি জুনাইদ আল হাবিব বলেন, ঘোষণাপত্রে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের গণহত্যার বিষয় সংযোজন করতে হবে। পাখির মতো গুলি করে ওলামায়ে কেরামকে হত্যা করা হয়েছে, হাজার হাজার ওলামায়ে কেরামকে গ্রেপ্তার করে বছরের পর বছর জেলখানায় বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে, সেটাও এখানে উল্লেখ থাকতে হবে।
গণসংহতি : গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমরা বলেছি, এটা যেন তাড়াহুড়া বা যেনতেন প্রক্রিয়ায় করা না হয়। ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য সরকারের দিক থেকে এই উদ্যোগটা নেওয়া দরকার।’ সরকারের পক্ষ থেকে একটি ড্রাফ কমিটি করা দরকার বলেও তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ড্রাফ কমিটি শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনদের মতামতকে যুক্ত করে প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে দলিলটি তৈরি করতে হবে।
হেফাজতে ইসলাম : হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি জুনাই আল হাবিব বলেন, জুলাই বিপ্লবের পরে যে বিপ্লবী সরকার গঠন হয়েছে, আমরা গত ৫ মাসে বিপ্লবী কোনো কিছুই দেখিনি। সুতরাং, সরকারকে বিপ্লবী হতে হবে, পরাজিত শক্তির দোসর এবং তাদের সহযোগী যে যেখানেই আছে প্রত্যেককে ধরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আগামী নির্বাচনে পরাজিত শক্তির কেউই অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
আলোচনার বাইরে যারা : এই বৈঠকে ১২ দলীয় জোটসহ কয়েকটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ ছাড়া আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বৈঠকে অংশ নেয়নি।
অসঙ্গতি নিয়ে সমালোচনা : বৈঠকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্যে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে নানা অসঙ্গতি এবং বৈঠক আয়োজনে সরকারের তরফ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অসামঞ্জস্য আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সেখানে নেতারা বলেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সঠিকভাবে আচরণ করছে না। বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো থেকে শুরু করে খসড়া ঘোষণাপত্র বিলি-বণ্টনেও সঠিক পন্থা নেওয়া হয়নি। কোনো কোনো দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, কোনো দলকে বুধবার গভীর রাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আবার খসড়া ঘোষণাপত্রও সব দলকে ঠিকমতো পৌঁছানো হয়নি। এর প্রেক্ষিতে কয়েকটি দল বৈঠকে জানায়, সময়মতো এবং অফিসিয়ালি তারা ঘোষণাপত্র না পাওয়ায় এটা নিয়ে তারা কোনো পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারেননি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন