১৯ জুলাই একদিনেই নিহত ১৪৮
আইটিজেপি-টিজিআইর প্রতিবেদন
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই একদিনেই ১৪৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৪৮ জনের মধ্যে ৫৪ জনকে মাথায় বা গলায় গুলি করা হয়েছিল। অধিকাংশেরই বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। হতাহতের মাত্রা এত বেশি ছিল যে ঢাকায় একটি হাসপাতালে আক্ষরিক অর্থে গজ ও ব্যান্ডেজ ফুরিয়ে যায়। ঢাকা একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হয়ে ওঠে। ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি) ও টেকগ্লোবাল ইনস্টিটিউট (টিজিআই) নামে দুটি সংস্থার ‘ব্লাডশেড ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল বুধবার বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আইটিজেপি ও টিজিআই। সংস্থা দুটি শেখ হাসিনা সরকার পতনের কয়েক দিন পর থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করতে মাঠে নামে এবং পরিবারগুলো ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নেয়।
প্রতিবেদনের পাশাপাশি আইটিজেপি ও টিজিআই এবং আউটসাইডার মুভি কোম্পানি দুটি প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করে। এতে সামাজিক মাধ্যমে প্রাপ্ত পুলিশি অত্যাচারের ভিডিও প্রমাণকে একত্রিত করে কী ঘটেছিল তা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। একটিতে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ বিপুলসংখ্যক তরুণ আন্দোলনকারীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করছে। অন্যটিতে মোহাম্মাদ হৃদয় নামে এক তরুণকে ৫ আগস্ট গাজীপুরে পুলিশ ধরে এনে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করে।
৬০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে উঠে আসে, নিহতদের পরিবারগুলোর একটি যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যেখানে তারা তাদের পা রক্তে ভিজিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত সন্তানদের খুঁজতে হাসপাতালের মর্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আহত কিংবা শহীদ পরিবারগুলোর কাছে অপরিচিত লোকজন ফোন করে গুলিবিদ্ধ সন্তান কিংবা ভাইবোনের খবর দিতেন। এরপর টালমাটাল অবস্থায় এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করা অথবা গুরুতর আহতাবস্থায় কোনোমতে বেঁচে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
প্রবল মানসিক আঘাতের মধ্যেও শোকাহত পরিবারগুলোকে ক্ষমতাসীনদের বৈরিতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রিয়জনের মৃতদেহ দাফনের জন্য মৃত্যুসনদ ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সংগ্রহ করতেও নানা ঝুঁকি ও ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। ভয় এবং আতঙ্কে আচ্ছন্ন ছিল দাফনের আয়োজন, যেখানে কিছু পরিবার বাধা এড়াতে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই গোপনে দাফন সম্পন্ন করেছে, যাতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মীদের কোনো বাধার মুখে পড়তে না হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কোনো অহিংস উপায় গ্রহণ করেনি কিংবা তাদের কোনো সতর্কতা জারি করেনি। পুলিশ আহতদের চিকিৎসায় কোনো সহায়তা তো করেইনি বরং প্রায়শই চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, শহীদ হৃদয়ের বোন জেসমিন ও শহীদ মুনতাসীর রহমান আলিফের বাবা গাজীউর রহমান, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, আইটিজেপির নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন সুকা, টেক গ্লোবাল ইনস্টিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশিদ দিয়া বক্তব্য দেন।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
হৃদয়ের বোন জেসমিন বলেন, আমার ভাই ৫ আগস্ট আনন্দ মিছিলে পুলিশের ধাওয়া খাইয়া গোলাগুলি থেকে জীবন বাঁচানের জন্য এক জায়গায় লুকাইছিল। ভিডিওতে দেখছেন কেমনে ধরে নিয়া ভাইরে গুলি করে হত্যা করল। লাশটা নিয়া গেছে। লাশটা আর দেয়নি। লাশ কোথায় গুম করল, লাশটা কই গুম করল। আমি ওত কথা বলতে পারি না, আমি শিক্ষিত না। বড় বড় আইনজীবীরা এখানে আছে আমার ভাইরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করছে, আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে জেসমিন বলেন, পাঁচ ছয়মাসেও আমার ভাইয়ের বিচার পাইনি, সরকারের কোনো সহায়তা পাইনি। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার ভাইয়ের দেহাবশেষ খোঁজে বের করার জন্য উপস্থিত সবার প্রতি আহ্বান জানান।
শহীদ মুনতাসিরের বাবা গাজীউর রহমান বলেন, আজ পর্যন্ত যত কেস হয়েছে যাত্রাবাড়ী ছাড়া আর কোথাও কেউ অ্যারেস্ট হইছে দেখি না। তাহলে কী হইতেছে, আজকে ৫-৬ মাস হয়ে গেছে কোনো পুলিশ হেলমেট বাহিনী অন্তত আমার মামলায় কেউ অ্যারেস্ট হয়নি। এদের যদি বিচার না হয়, তাহলে আমাদের কী হবে, আমরা প্রত্যেকে তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছি।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, যখনই অত্যাচারে মৃত্যুর দৃশ্য দেখি, মনে হয় বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমাদের প্রসিকিউশনের তদন্ত টিম কাজ করছে। আমি কথা দিচ্ছিÑ এটার সুবিচার নিশ্চিত করবই। এ সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের সুবিচার নিশ্চিত করা। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচারের চেয়ে আমাদের বিচার যে ভিন্ন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আপনাদের মতো আমাদেরও তাড়না থাকেÑ কালকেই যদি বিচার হয় খুশি হতাম। কিন্তু আমাদের তো প্রসেস মেইনটেইন করতে হবে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ সরকারের লোকজন) যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে, তাদের শনাক্ত করার পাশাপাশি এটি বের করা জরুরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠল? কেন রাষ্ট্র এ পর্যায়ে গিয়েছিল, কার নির্দেশে তারা এ কাজ করেছিল? এগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের গায়েবি নির্দেশের উৎস জানতে পারলে সুপিরিয়র কমান্ড দায় নির্ণয় করা যাবে। তিনি বলেন, শহীদ পরিবারদের দ্রুত বিচার চাওয়ার প্রক্রিয়াকে আমরা শ্রদ্ধা করি। তবে বিচার প্রক্রিয়া যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত হওয়ার জন্য ধৈর্য ধরার অনুরোধ করব। তিনি আরও বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পর একটা রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে নতুন যাত্রা শুরু করবে।