মড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে খাঁড়ার ঘা

আব্দুল্লাহ কাফি ও রেজাউল রেজা
১১ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
মড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে খাঁড়ার ঘা

পুঁজির ঘাটতি, ডলারের উচ্চমূল্য, সুদের উচ্চহার, আমদানি কড়াকড়ি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় অনেক দিন ধরেই দেশের শিল্প-কারখানার চাকা গতি হারিয়েছে; কঠিন সময় পার করছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরিবেশ অনেকটাই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। তদুপরি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যোগ হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। যার প্রভাব পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে, নেমে আসে স্থবিরতা। সেই পরিস্থিতি এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি, এখনও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ফিরে আসেনি স্বস্তি। উপরন্তু অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে শতাধিক পণ্য-সেবার ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা বলছেন, এভাবে মড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে একের পর এক খাঁড়ার ঘা পড়তে থাকলে শিল্পের বিকাশ স্থবির হয়ে পড়বে, বাধাগ্রস্ত হবে কর্মসংস্থান। দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের জেরে দীর্ঘ সময় ধরে ভুগছে শিল্প খাত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের প্রত্যাশা ছিল ব্যবসায় গতি ফিরবে। কিন্তু আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, মালিকানা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাসহ নানা রকম অস্থিরতা বিরাজ করে। এতে আরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় ব্যবসায়ীদের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ছিল- ব্যবসা-সহায়ক নীতি গ্রহণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার। অথচ একের পর এক চাপে পিষ্টপ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু আমাদের সময়কে বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ তৈরি হবে না। দেশের মানুষ এখনও জানে না রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এখন নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছেন। নির্বাচন যখনই হোক না কেন, তার একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা থাকা দরকার বলে মনে করছেন তিনি।

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সাধারণ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। দেশের স্বার্থেই ব্যবসায়ীদের হয়রানি মুক্ত রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায় নতুন করে চাপ বাড়ছে জানিয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর ফলে উৎপাদন খাতের টিকে থাকা আরও কঠিন হবে। দেশের তরুণরা কর্মসংস্থানের জন্যই আন্দোলন করেছে। এখন প্রয়োজন শিল্পের বিকাশ, যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে। অথচ যেসব নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে, সেগুলো এর বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে উল্টো কমবে। তিনি আরও বলেন, আইএমএফের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে শিল্প খাতের ক্ষতি করা যাবে না। ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় শিল্পের উৎপাদন কমবে। যার প্রভাব পণ্যমূল্যে পড়বে। অপরদিকে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেটা হলে কোনো অবস্থাতেই শিল্প খাত প্রতিযোগিতামূলক হবে না। পণ্য উৎপাদন ব্যয় যদি প্রতিযোগিতামূলক না হয়, তাহলে তো শিল্প-কারখানা করে লাভ নেই।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর শিল্প প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, মালিকানা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাসহ নানা রকম অস্থিরতার মধ্যে বেশ কিছু কারখানা ভাঙচুর ও লুটতরাজের শিকার হয়েছে। চাঁদা না পেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে। কোথাও ব্যক্তিগত রেষারেষিকে রাজনৈতিক মেরুকরণ করে মামলার আসামি করার মতো কা-ও ঘটেছে। কাউকে কাউকে মামলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় আতঙ্কে দিন পার করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের কেউ কেউ মামলার আসামি হয়ে বিপাকে পড়েছেন, অনেকে মামলার আসামি হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে আছেন। ফলে তাদের কেউ দেশছাড়া হয়েছেন, কেউ দেশে থেকেও দীর্ঘদিন নিজ প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন না। অনেকে ব্যবসায়িক কাজে বিদেশ গিয়ে ফেরত আসতে চাইলেও পরিস্থিতি অনুকূল মনে করছেন না। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি নিরীহ ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন। ফলে দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে যেসব নীতিমালা গ্রহণ করা হচ্ছে, তা ব্যবসায়ীদের আরও চাপে ফেলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক না কাটলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, সাধারণ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করতে দিতে হবে। হয়রানিমূলক মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে ভয় কাটাতে হবে। না হলে অর্থনীতির বড় ক্ষতি হবে। সেই সঙ্গে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও বৃদ্ধি পাবে। ব্যবসার গতি বাড়ানো না গেলে তা রাজস্বের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ব্যবসায় গতি আনতে ব্যবসাবান্ধব নীতি ও পরিবেশ প্রয়োজন, যাতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলে। কিন্তু বর্তমানে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় ব্যবসা আরও চাপে পড়বে। ব্যবসায় স্বাভাবিক গতি না থাকলে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করা হবে কার কাছ থেকে? তাই আগে ব্যবসা সচলের পথ সুগম করতে হবে। তাহলে রাজস্ব আয় এমনিতেই বাড়বে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যবসায় স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। এর সঙ্গে লাল ফিতার দৌরাত্ম্যও বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনা দরকার। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহযোগিতাও প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপাতত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। স্থবিরতা এখনও চলমান, তাই এখনই ভালো কিছু আশা করা যাচ্ছে না। এখনও বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন চলে, তা দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়। ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে বিনিয়োগ বাড়বে না। তবে এ বছরের শেষের দিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। তিনি আরও বলেন- ভ্যাট, ট্যাক্স ও গ্যাসের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে। তবে অনিয়ম ও সিস্টেম লস কমানো গেলে এই সংকট কিছুটা হলেও কেটে যেত।

নতুন করে শুল্ক-কর বাড়ায় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে রয়েছে রেস্তোরাঁ ও হোটেল-রিসোর্ট খাত। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, বর্ধিত ভ্যাট ও আগের সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ১০ শতাংশ যোগ করা হলে ভোক্তাদের মোট ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে। গুলশান ও বনানীর মানুষেরা এই ভ্যাট দিতে পারেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা দেওয়া সম্ভব নয়, বিষয়টি অবাস্তব। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই রেস্তোরাঁ ব্যবসা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এ অবস্থায় ভ্যাট বাড়লে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিতে হবে।

ব্যবসা মন্দার মধ্যে শুল্ক-কর বাড়ায় হোটেল-রিসোর্ট খাতে নতুন করে চাপ তৈরি হবে বলে জানান ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ। অরুনিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাবের চেয়ারম্যান খবির উদ্দিন বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানা সমস্যায় দেশের হোটেল ও রিসোর্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত। লোকসানের মুখে থাকা এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে আমরা ভ্যাট কমানোর কথা বলে আসছি। সেখানে উল্টো বাড়ানো হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীরা হতাশ। এ ছাড়া উড়োজাহাজের টিকিটের দাম বাড়লে ট্যুরিজম খাত আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।