সরকার-ছাত্র মতভেদে জলঘোলা হচ্ছে (ভিডিও)
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে ক্রমেই ঘোলা হচ্ছে জল। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষণে ক্ষণে মত বদলাতে দেখা যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষ থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার পর ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। এর আগে, ২৯ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়- গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের সাথে সরকারের সম্পর্ক নেই।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র দিতে সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারের পক্ষ থেকে নতুন বার্তা দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করবে না, বরং সরকার এ প্রক্রিয়াকে ফ্যাসিলিটেট (সহজতর) করবে। তবে এ জন্য কিছুটা সময় লাগবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি দেখা দিচ্ছে।
১৫ জানুয়ারি শেষ হবে আগামী বুধবার। সরকার চাইছে আগামী সপ্তাহের মধ্যে অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারির মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা শেষ করবে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহেও ঘোষণাপত্র দেওয়া সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আবার মাঠে নামতে পারে- এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তিনি বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা এটা করব। সবার কথা শোনা হবে। পরবর্তীতে কতটুকু সংস্কার করা হবে, যেমন সংবিধান সংস্কার বা বাতিলের প্রশ্ন আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক করা হবে।
উপদেষ্টা মাহফুজ আরও বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব সংগঠনের সঙ্গে আমরা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে বসব। আমরা আশা করি, আগামী সপ্তাহের মধ্যে এটা শেষ হবে। দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং দলগুলোর বাইরে সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও সরকারের পক্ষ থেকে আমরা আলোচনা করব।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গত ৩১ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্র গৃহীত হবে।
এর আগে, ২৯ ডিসেম্ব প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জুলাই বিপ্লবের যে ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হবে, তার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
১৯৭২ সালের সংবিধান ছুড়ে ফেলার বিষয়ে সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, এটার প্রস্তাবনা আছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে হয়তো এর বিরোধিতা করছে। এটা একটি বিতর্কিত পয়েন্ট। এসব বিতর্কিত পয়েন্ট আমরা আলোচনা করে লিপিবদ্ধ করব।
মাহফুজ আলম বলেন, ৭২-এর সংবিধানের প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একটা দাবি আছে। ৭২-এর সংবিধান যখন থেকে প্রণীত হয়েছে, তখন থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এটাকে ক্রিটিক্যালি (সমালোচনামূলকভাবে) দেখেছেন। বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষিত, যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এটি গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার। এখানে এক কথায় একটি শব্দ দরকার, সেটি হচ্ছে ‘ঐকমত্য’। সংবিধানের বিষয় আমরা কী করব, সে বিষয়ে এই ঐকমত্যের জায়গা থেকে আমাদের পৌঁছতে হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে নিজেদের অবস্থানের ব্যাপারে মাহফুজ আলম বলেন, সরকার কোনো ঘোষণাপত্র দেবে না। এটি আসবে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা এবং সব রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের বিষয়টি নিয়ে অনেক জলঘোলা হবে। ঘোষণাপত্র নিয়ে শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে প্রস্তাবনা দিয়েছেন। ঘোষণাপত্র কিন্তু সরকার দেবে না। সরকার ফ্যাসিলিটেড করবে। প্রক্রিয়াটি নিয়ে কাজ করছে সরকার। এই দুটি জিনিস সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা সরকার নিজে তৈরি করে কোনো প্রক্লেমেশন দিচ্ছি না। শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা ও সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র প্রণীত হবে।
মাহফুজ আলম বলেন, ছাত্ররা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তারা একটি ঘোষণাপত্র দেবেন। কিন্তু সরকার যখন অনুভব করল যে, বিষয়টি শুধু ছাত্রদের দিক থেকে গেলে সেটি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ফলে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, গণ-অভ্যুত্থানের যত পক্ষ আছে, সবার সঙ্গে সরকার কথা বলে আগামী সপ্তাহে এই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে এবং কবে এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ হবে, সরকার সবার সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত জানাবে। আগামী সপ্তাহ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র তৈরি করা। এই সময় কিছুটা বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু খুব বেশি দেরি হবে না। হয়তো তাদের সময়সীমার কয়েক দিনের মধ্যেই হয়ে যাবে।
জাতীয় নির্বাচন আগে হবে, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন- এমন প্রশ্নে মাহফুজ আলম বলেন, আমরা আসলে প্রশাসক দিয়ে জনগণের কাছে সেবা পৌঁছতে পারব কি না- এ বিষয়ে যেহেতু আমাদের সংশয় তৈরি হয়েছে, যদি সিটি করপোরেশনের দিকে তাকান কিংবা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের দিকে তাকান, অনেক সরকারি সেবা জনগণ পাচ্ছে না। আমরা দেখছি যে, প্রশাসক দিয়ে কীভাবে সামলানো যায়। এটা প্রধান উপদেষ্টা একটা প্রস্তাবনা হিসেবে বলেছেন যে, যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়, তাহলে নাগরিকদের সেবা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হবে। আমি মনে করি, এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে আমরা অগ্রসর হতে পারব।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন সংস্কার-সাপেক্ষ। এটি প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে এরই মধ্যে দেখেছেন। আমরা আশা করি, সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট এই মাসের মধ্যে পাব। প্রথম যে ছয়টি কমিটি হয়েছিল, সেগুলো নির্বাচন সংশ্লিষ্ট। এই কমিশনগুলো যেসব প্রস্তাবনা দেবে সেগুলো নির্বাচনকেন্দ্রিক। প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করব। এ প্রক্রিয়ায় প্রবেশের পর রাজনৈতিক দলগুলোই আসলে ঠিক করবে, কতটা সংস্কার চাই। ওই সংস্কার মধ্যমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি বা কী ধরনের মেয়াদি হয়; ওই সংস্কারের মেয়াদ বা পরিধির ভিত্তিতে আমি মনে করি নির্বাচনের তারিখ ঠিক হবে। সুতরাং, এটি আজ-কালের মধ্যে ঠিক হওয়া যৌক্তিক হবে বলে আমি মনে করি না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
এদিকে নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সবার হাতে নতুন বই দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আজকের ক্যাবিনেট মিটিংয়ে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।