সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে কমিশনগুলোর মতভেদ
রাষ্ট্র সংস্কারে ১১টি কমিশন গঠন করেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব কমিশনের প্রতিবেদন প্রায় চূড়ান্ত। চলতি মাসেই গুরুত্বপূর্ণ ৬টি কমিশনের সুপারিশমালা দাখিল করা হবে। কিন্তু এরই মধ্যে একাধিক কমিশনের সুপারিশ নিয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সংস্কার কমিশনের এসব প্রতিবেদন জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা হবে কিনা, এ নিয়েও মতভিন্নতা রয়েছে। জানা গেছে, সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিবেদন দাখিলের পর এসব নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করবে সরকার।
সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে গত শনিবার দিনভর বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় একাধিক কমিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে কোন কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে- প্রভৃতি বিষয় সংবিধান সংস্কার কমিশনের পাশাপাশি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গেও সম্পর্কিত। এসব বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে। তবে এখনও কিছু বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মধ্যে কিছু মতদ্বৈধতা আছে। এসব বিষয়ে এ দুটি কমিশনের মধ্যে আরও আলোচনা হবে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হবে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
অধিকাংশ কমিশনের প্রধানই প্রতিবেদন প্রকাশ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে উপদেষ্টাদের মধ্যে মতের ভিন্নতা আছে। এখনও তাই কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, এখনও প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়নি। আমরা এরই মধ্যে বসেছিলাম। আলোচনা করছি। অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছি। দুই কমিশনের অভিন্ন সুপারিশ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত বসছি। আবারও বসা হবে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ জনসমক্ষে প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে বদিউল আলম বলেন, এটা সরকারের বিষয়। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। আশা করি তারা প্রকাশ করবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, দুটো কমিশনের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। সম্প্রতি তারা সভা করেছেন। তাদের বক্তব্য তারা শুনেছেন। কিছু ব্যাপারে তারা ওভারল্যাপ করবে। কারণ এগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। ইতোমধ্যে তারা মতবিনিময় করেছেন। এটা ইতিবাচক দিক। বিষয়গুলো আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেই অগ্রসর হওয়া উচিত। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি আছে। বিষয়গুলো ট্রায়াল অ্যান্ড এররের ভিত্তিতে হচ্ছে। যখন বাস্তবে আসবে, তখন এর ফল বোঝা যাবে। মতামত বিনিময় করে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটা সুপারিশমালা যেন তৈরি হয়, জনগণ সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে। যারা স্টেকহোল্ডার তারাও তাকিয়ে আছেন। প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়ে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রধানরা ইতোমধ্যে অনেক বিষয় প্রকাশ করেছেন। এই প্রতিবেদন অবশ্যই জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করবে। দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বেশ কিছু ক্ষেত্র আছে, যেগুলো কমিশনগুলোর পরস্পরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বা সম্পূরক। এ ধরনের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যাতে সমন্বয় থাকে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এ সংলাপ করবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছিল ৩ অক্টোবর। এই পাঁচ কমিশনকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসাবে ২ জানুয়ারির মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। আর সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল ৬ অক্টোবর। ৫ জানুয়ারির মধ্যে এ কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। গত ৪ নভেম্বর প্রথম ধাপের ছয় কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে কমিশনগুলোর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়। এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা হয় গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। এগুলোর প্রতিবেদন জমার জন্য আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
প্রথমে গঠিত ছয় কমিশন ওয়েবসাইট খুলে মতামত সংগ্রহ, অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ, মতবিনিময়, জরিপ ও লিখিতভাবে মতামত সংগ্রহ করেছে। সুপারিশমালা প্রস্তুতে এসব প্রস্তাব ও মতামত পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে শনিবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে ১১টি কমিশনের প্রধানরা অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন