নতুন বছরে চ্যালেঞ্জ প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও গতি ফেরানো

এম এইচ রবিন
০৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নতুন বছরে চ্যালেঞ্জ প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও গতি ফেরানো

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গভীর সংকটে পড়ে জনপ্রশাসন। গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সাজানো দলীয় প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে বড় পরিবর্তন, পদোন্নতির হিড়িক, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের নিরবচ্ছিন্ন দাবি-দাওয়ার আন্দোলন, অনভিজ্ঞতায় চরম বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে প্রশাসন। সর্বশেষ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাব ঘিরে উত্তাল হয় প্রশাসন। এর মধ্যে খসড়া সুপারিশের বিরোধিতা করে আন্দোলন করছেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। এর বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কাজেকর্মে নেমেছে স্থবিরতা। ফলে আগামী বছর প্রশাসনের সামনে সংকট কাটিয়ে গতি ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও আমলাদের মতে, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিগত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতার আলোকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে নতুন করে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি না হয়। গণ-অভ্যুত্থানের সাড়ে চার মাসেরও বেশি সময়ে শৃঙ্খলা ফেরেনি প্রশাসনে। আগস্টের বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণে যতটুকু আশা জেগেছিল, তা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশের কারণে ভেস্তে গেছে।

চলমান পরিস্থিতিতে গত ৩১ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- জনসেবা প্রদান এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকারি কর্মচারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সরকারি কর্মচারীদের সুশৃঙ্খল, দায়িত্বশীল ও পেশাদার আচরণের ওপর জনপ্রশাসনের সফলতা নির্ভর করে। সম্প্রতি বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মচারীর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ বিবিধ কর্মসূচি পালনের কারণে সরকারি কর্মচারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে, সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত, আদেশ বা সংস্কার কার্যক্রমের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার আগেই বিবেচ্য বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরূপ মন্তব্যসহ বিবৃতি প্রকাশ করা হচ্ছে, যা ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ এর পরিপন্থি।

এর আগে উপসচিব কোটা নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা গত ২২ ডিসেম্বর সচিবালয়ে নজিরবিহীন অবস্থান কর্মসূচি এবং ২৫ ডিসেম্বর বিয়াম মিলনায়তনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।

উপসচিব পুলের কোটা বাতিল, কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে সিভিল সার্ভিসের বাইরে নিতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের প্রতিবাদে গত ২৪ ডিসেম্বর কলমবিরতি এবং ২৬ ডিসেম্বর মানববন্ধন করেছেন ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

গণ-অভুত্থ্যানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। কোনো কোনো কর্মকর্তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে, পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে, পদায়ন করা হচ্ছে কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে চার মাসে জনপ্রশাসনে প্রায় সাড়ে ৫০০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে শতাধিক কর্মকর্তার। ওএসডিও করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে। তাদের স্থলে অবসরে যাওয়া অনেক কর্মকর্তাকে চুক্তিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাড়ে চার মাসে ২৩ জন কর্মকর্তারাকে সচিব করা হয়েছে। ১৭ জন কর্মকর্তা গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। অতিরিক্ত সচিব ১৩৫, যুগ্ম সচিব ২২৮ এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৩৪ জন। ১৪টি মন্ত্রণালয়ে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চুক্তিতে।

আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে পদোন্নতি ও পদায়ন করতে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হচ্ছে। অনিয়মে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়েছেন। বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সচিব কিংবা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে, যা সমালোচনার সৃষ্টি করছে। এ জন্য ভুলগুলো শুধরে বারবার সিদ্ধান্ত বদলাতে দেখা যাচ্ছে প্রশাসনে। নীতিনির্ধারণী পদের কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতা সংকটকে আরও গভীর করেছে। অন্যদিকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ায় পদোন্নতি যোগ্য কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে হতাশ ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।

গণ-অভ্যুত্থানের পর সুযোগ বুঝে অনেকেই অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া তুলেছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন মোকাবিলায় নাজেহাল হতে হয়েছে সরকারকে। দাবি আদায়ে আনসার কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের সচিবালয় ঘেরাও করে রাখার কর্মসূচির মুখোমুখিও হতে হয়েছে প্রশাসনকে।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দিন বলেন, যে কোনো সময় সরকার পরিবর্তনের সময় সবখাতে একটা নাড়াচাড়া পড়ে। গণ-অভুত্থ্যানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেটিই হয়েছে। এখন অতীত কাটিয়ে নতুন করে প্রশাসন ঢেলে সাজানো হচ্ছে, এতে আরও গতিময় হবে নতুন বছরে এটাই মানুষের প্রত্যাশা। দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনেই সময় কাটছে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। দপ্তরগুলোয় বিঘিœত হচ্ছে সেবা প্রদান প্রক্রিয়া। এখন নিরবচ্ছিন্ন দাবি-দাওয়ার যে আন্দোলন হচ্ছে এটি সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে।

প্রশাসনে আরো গতি বাড়ানোয় সরকারকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনে শুরু থেকে যে ঢিলেঢালা ভাব ছিল সেটি অনেকটা কাটিয়ে ওঠছে। ঠিক এমন সময় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ইস্যুতে সিভিল সার্ভিসে একধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।