বাজার খরচের চাপ নিয়েই নতুন বছর শুরু
খাদ্য মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করে দেশের সাধারণ মানুষ ক্লান্ত। ২০২৪ সালের পুরো বছরই গেছে মূল্যস্ফীতির নাকানিচুবানি খেয়ে। এর মধ্যে টানা আট মাস (গত এপ্রিল থেকে নভেম্বর) পয়েন্ট টু পয়েন্ট হিসাবে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে। সর্বশেষ হিসাবে গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ আগের বছর নভেম্বরে যে খাদ্যপণ্য ১০০ টাকায় কেনা গিয়েছে, তা গত নভেম্বরে কিনতে হয়েছে প্রায় ১১৪ টাকায়। এমন বাস্তবতার মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন বছর। এক বছরের ব্যবধানে চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস ও মসলাসহ প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। নতুন বছরে তাই বাজারে স্বস্তি চায় সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ নভেম্বরের হিসাব বলছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরের চেয়ে নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে। আগের বছর ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে খাদ্য মূূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। খাবারের পেছনে এতটা বেশি খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছে না নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে দরিদ্র ও খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার প্রতিবেদনে নজর দিলেও দেখা যায়, কয়েকটি পণ্য ব্যতীত বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে বাজারের প্রকৃত হিসাবে দাম আরও বেশি বেড়েছে। চালের বর্ধিত দাম নিয়ে বেজায় চাপে আছেন ভোক্তারা। টিসিবির হিসাবেই উঠে এসেছেÑ এক বছরে সরু চালের দাম ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মাঝারি চালে ১৭ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়েছে। দরিদ্রের মোটা চালের দামও কেজিতে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়েছে। ডালের পেছনেও খরচ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মুগ, ছোলা ও অ্যাংকর ডালের। টিসিবির হিসাবেÑ এক বছরে ছোট দানার মসুরের দাম ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, মুগ ডালে ৪৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং ছোলায় ৩৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ দামে বেড়েছে। আর নিম্ন আয়ের মানুষের অ্যাংকর ডালের দাম এক বছরে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
এক বছরে বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১ দশমিক ৪৮ থেকে ২ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের খোলা সয়াবিনের দাম বেশি বেড়েছে; ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। খোলা পাম তেলের দাম ২২ দশমিক ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। পেঁয়াজ ও আলুর দাম সম্প্রতি কমেছে। তবে দেশি রসুন, আদা ও হলুদের দাম বেড়েছে। মসলার বাজারে এলাচের দাম এক বছরে ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। দারুচিনি, তেজপাতা, ধনের দামও বেড়েছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
মাংসের বাজারে গরুর মাংসের দাম ১৯ দশমিক ২৩ শতাংশ, খাসির মাংসের দাম সাড়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। উচ্চমূল্যের বাজারে স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা ছিল মুরগিতে। সেটার দামও গত এক বছরে বেড়ে গেছে। টিসিবির হিসাবে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে প্রায় ১১ শতাংশ বেড়েছে। প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস হিসাবে পরিচিত ফার্মের ডিমের দামও এখন নাগালের বাইরে। প্রতি হালিতে (৪ পিস) খরচ ৯ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে। মাছের বাজারেও খরচ বেড়েছে।
এক বছরের ব্যবধানে এত বেশি হারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। খেই হারিয়ে ফেলছেন মধ্যবিত্তরাও। অসহনীয় এ খরচের চাপ থেকে মুক্তি চান সবাই।
কারওয়ান বাজারের দিনমজুর মো. আলী আহম্মদ বলেন, ‘সারাদিন বাজারে দিনমজুরের কাজ করে যে সামান্য টাকা আয় হয়, তা দিয়ে বাড়ি ভাড়ার পর চাল, ডাল, তেল কিনতেই হিমশিম খাইতে হয়। মাছ মাংস ডিম এইগুলো খাওন ছাইড়াই দিছি। তারপরও হিসাব মেলে না। খরচের এই চাপ থেইক্কা রেহাই পামু কবে।’
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
বাজার নিয়ন্ত্রণে নতুন কৌশল প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় অনেক ত্রুটি রয়েছে, সেটা সুস্পষ্ট। আমরা পুরনো কৌশলেই আটকে আছি। এগুলো তো আগের সরকারও করেছে। সমাধান হয়নি। অভিযান-জরিমানার মতো পুলিশি কায়দায় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। অথচ যেখানে পুলিশি কায়দা প্রয়োগের দরকার, করছি না। আবার প্রতিযোগিতারও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। চাঁদাবাজি আবার শুরু হয়েছে। শুল্ক ছাড় দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা ব্যবসায়ীরা ভোগ করলেও ভোক্তারা বঞ্চিত থাকছেন। সুতরাং, পুরনো পথে হাঁটলে চলবে না। সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে হবে।
বাজার সংশ্লিষ্টরাও একই কথা জানান। মো. মোশাররফ হোসেনসহ কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের বাজারে আগের মতোই দাম বাড়ানো হচ্ছে। মিলগেটে দাম বাড়িয়ে দিলে তখন বাজারেও দাম বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি হঠাৎ করে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছে।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদারও জানান, এক সময়ের সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিমের দাম সিন্ডিকেট চক্র কারসাজি করে তা দামি পণ্যে পরিণত করেছে। এক দিনের বাচ্চা ও ফিডের বাজার দখলে নিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে। উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে নয়, আগের মতো মোবাইলের মাধম্যে প্রতিদিন দাম ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
শ্যামবাজারের পেঁয়াজের পাইকারি বিক্রেতা কানাই সাহাসহ অন্যরা জানান, আগের কায়দাতেই বাজার চলছে। এখনও কমিশনবাণিজ্য চলে। মোবাইলে যে দাম বলে দেওয়া হচ্ছে, সে অনুযায়ী বাজার ওঠা-নামা করছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, সরকারি অনুসন্ধান ও তদারকি অভিযানেও উঠে এসেছে এমন তথ্য। অভিযুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠানকে করা হচ্ছে জরিমানা। কিন্তু বছর ঘুরে নতুন বছর এলেও কিছুই বদলায় না। আমাদের আইন থাকলেও তার প্রয়োগ দেখি না। বারবার পার পেয়ে গিয়ে আবার কারসাজি করছে অসাধুরা, আর পকেট কাটা পড়ে ভোক্তার।