জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠে আলটিমেটাম

মার্চ ফর ইউনিটিতে হাসিনার ফাঁসি দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক
০১ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠে আলটিমেটাম

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ ফর ইউনিটি‘ শীর্ষক সমাবেশ। এ কর্মসূচি থেকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠে অন্তর্বর্তী সরকারকে আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। 

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি শুরু হয় বিকাল তিনটায়। দুপুরের পর থেকে এই ঐক্যের যাত্রায় যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন জেলার ছাত্র-জনতার স্রোত নামে। এ সময় নানান সেøাগান দিতে দেখা যায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের জনপ্রিয় সেøাগান ‘তুমি কে আমি কে বাংলাদেশ বাংলাদেশ’; ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’; ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘ক্ষমতা না জনতা, জনতা জনতা’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম-সংগ্রাম’, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’, ‘দড়ি লাগলে দড়ি নে, খুনি হাসিনার ফাঁসি দে’; ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন ভারতে’; ‘একটা একটা খুনি ধর, ধইরা ধইরা বিচার কর’ প্রভৃতি সেøাগান দিতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। 

মূল সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর মঞ্চ থেকে সেøাগান শুরু হয়। বিকাল চারটার দিকে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে একজন শহীদের বাবার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। এই সমাবেশে সহযোগিতা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি। 

শহীদ শাহরিয়ার হাসান আলভীর বাবা আবুল হাসান বলেন, আমার ছেলে শাহরিয়ার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০-এ শহীদ হয়েছে। আমাদের কান্না কখনও থামবে না, এই বেদনা শেষ হওয়ার নয়। খুনি হাসিনা ও তার হেলমেট বাহিনী আমাদের ওপর পাখির মতো গুলি চালিয়েছে। আমরা খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ২৪-এ বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। আমরা আর কোনো নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দেখতে চাই না। দেশের প্রতি কোনো রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি চলবে না। টেন্ডারবাজির বাংলাদেশ দেখতে চাই না। তিনি বলেন, শহীদ ও আহতদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, সেটি একটি ঘোষণাপত্রে লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছিলাম। সরকার দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে আলোচনা করে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা নিহত হয়েছেন, অঙ্গ হারিয়েছেন তাদের কথাগুলো যদি ঘোষণায় উল্লেখ না থাকে তাহলে জনতা সেই ঘোষণা মেনে নেবে না।

সমাবেশে আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠের দাবি জানান জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ এক নতুন বাংলাদেশ চায়, নতুন সংবিধান চায়, সংস্কার চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ যখন জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠের আয়োজনের ঘোষণা দেয়, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে ঘোষণাপত্র পাঠের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বলতে চাই, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠ করতে হবে। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান হবে। আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে নির্বাচিতরাই সংবিধান সংশোধন করবে। বাংলাদেশের মানুষের অসংখ্য চাওয়া আছে, আগামীর নির্বাচনে যারা জয়ী হবেন, সেই চাওয়াগুলো তাদেরই পূরণ করতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের অভ্যুত্থান আওয়ামী লীগ মেনে নিতে পারেনি। এ জন্য সচিবালয়ে, বিচারালয়ে ষড়যন্ত্র চলে। আগে চলত সতীদাহ প্রথা, আর এখন চলে নথিদাহ প্রথা। আমি বলতে চাই, আপনারা রিয়েলিটি মেনে নেন। হাসনাত বলেন, কোনো বিপ্লবীকে যদি আর খুন করা হয় তাহলে এই সরকারকে তার দায়ভার নিতে হবে। অতি শিগগিরই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। আলেম ওলামাদের প্রতি যে হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে, সেগুলোর বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর আমাদের আর কোনো শত্রু নাই। আমাদের একমাত্র শত্রু আওয়ামী লীগ। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, জুলাই এখনও যায় নাই। আমরা জুলাই শেষ হতে দেব না। একাত্তরে, নব্বইয়ে বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু আমরা চব্বিশকে ব্যর্থ হতে দেব না।

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব সারজিস আলম বলেন, আমরা সরকারের কাছে এই গণহত্যার বিচার চাই। আমরা পাচার করা অর্থ ফেরত চাই, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ চাই এবং আহত যোদ্ধাদের সুচিকিৎসা চাই। সরকারকে আহ্বান জানাতে চাই, আমাদের দেশ সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে যাবে। কিন্তু সেই সুযোগে যদি কেউ আমাদের মাথায় উঠে বসতে চায়, তাহলে আমাদের মাথা থেকে তাদের ফেলে দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারগুলোতে এখনও খুনির দোসররা ঘাপটি মেরে আছে। সচিবালয় হোক বা যে কোনো জায়গা থেকে ষড়যন্ত্র করলে আমরা তাদের উৎখাত করে ছাড়ব।

সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম, জাহিদ হাসান প্রমুখও বক্তব্য রাখেন।

এ অনুষ্ঠানের ঘণ্টা দুই আগে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রশিবিরের সদস্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনেও সারজিস আলম বক্তব্য দেন। ছাত্র শিবিরের সম্মেলন থেকে অনেকেই যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে। তবে এতে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কাউকে দেখা যায়নি। গণঅধিকার পরিষদসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও ছিলেন গরহাজির। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান

সমাবেশস্থলে পুলিশ, পুলিশের ডগ স্কোয়াড, র‌্যাব, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেছে। এদিন রাজধানীর প্রতিটি সড়কে সেনাবাহিনীর টহল গাড়ি দেখা গেছে। বিশেষ করে শাহবাগ থেকে শুরু করে টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ আশপাশের এলাকায় ছিল বাড়তি নজরদারি। 

ঢাকায় আসার পথে সংঘর্ষ : বাগেরহাটের মোল্লাহাটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর ইউনিটির’ গাড়িবহরের একটি গাড়িকে সাইড না দেওয়াকে কেন্দ্র করে কথা-কাটাকাটি এবং এর জেরে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে খুলনা মহানগর থেকে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’তে যোগ দিতে শিক্ষার্থীদের বহনকারী ২৫টি বাস ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। বহরের একটি গাড়ি কিছুটা পেছনে পড়ে। ফকিরহাটের নওয়াপাড়া এলাকা থেকে শুরু করে মোল্লাহাটের একটি পাম্প পর্যন্ত ওই গাড়িকে যাত্রীবাহী একটি বাস বারবার চাপ দিচ্ছিল। সাইড দেওয়া নিয়ে ওই গাড়ির লোকজনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ওই গাড়িসহ স্থানীয় বাস কাউন্টারের লোকজন কয়েক শিক্ষার্থীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করে। শিক্ষার্থীদের বহনকারী সেবা গ্রীনলাইন গাড়িটির কাচ ভাঙচুর করেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ বাধে। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন।