সাড়ে ২২ হাজার অগ্নিকাণ্ড, ১৮৫০ ঘটনার ক্লু নেই
ফায়ার সার্ভিসের ১০ মাসের পরিসংখ্যান
বড়দিনের ছুটির রাতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বুধবার গভীর রাতে ৭ নম্বর ভবনের চার ফ্লোরে থাকা ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রায় ২০০ কক্ষ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীর মৃত্যু এবং কুকুর ও কবুতরের দগ্ধ দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার পাঁচ দিন পরও আগুন লাগার কারণ নির্ণয় করতে পারেনি তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
সচিবালয়ের মতো কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় এমন অগ্নিকাণ্ড নিয়ে কেউ বলছেন ষড়যন্ত্র, কেউবা দাবি করছেন এটি পরিকল্পিত। শুধু সচিবালয়ের ঘটনাই নয়, চলতি বছরের গত ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) সারাদেশে আরও ১ হাজার ৮৫০টি অগ্নিকাণ্ডের কোনো ক্লু খুঁজে পায়নি তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
১০ মাসে ২২ হাজার অগ্নিকাণ্ড : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তর অগ্নিকাণ্ডের ২৬টি কারণ চিহ্নিত করেছে। দপ্তরটি জানায়, গত ১০ মাসে সারাদেশে ২২ হাজার ৪৬৩টি
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ৭ হাজার ৫৯৩টি, যা সর্বোচ্চ। বিড়ি-সিগারেটের আগুনে ৩ হাজার ৩৬৯টি এবং চুলার আগুনে ২ হাজার ৭৫৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে ৬০২টি, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩৯টি, গ্যাস সরবরাহ লাইন লিকেজ থেকে ৪২২টি অগ্নিকাণ্ড হয়। এ ছাড়া শিশুদের আগুন নিয়ে খেলা, কয়েল, উত্তপ্ত ছাই, খোলা বাতির ব্যবহার, উচ্ছৃঙ্খল জনতার মাধ্যমে, যানবাহনের দুর্ঘটনাজনিত কারণে, সুয়ারেজ লাইনে জমা গ্যাসে, শত্রুতামূলক অগ্নিসংযোগসহ আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ জানানো হয়।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
১০ মাসে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয়েছে ৬৩০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার ৫১৬ টাকা। উদ্ধার কাজে গিয়ে আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ৩৪ সদস্য। তবে ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় ১ হাজার ১৫২ কোটি ৯৯ লাখ ২৯ হাজার ৬৯০ টাকার সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ২০২৩ সালে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৯২ কোটি টাকা। এসব আগুনের ঘটনায় সারাদেশে ২৮১ জন আহত ও ১০২ জন নিহত হন।
অগ্নিঝুঁকিতে ৪২ শতাংশ ভবন : গত ১০ মাসে সারাদেশে ৬ হাজার ৬২০টি সরকারি-বেসরকারি ভবন পরিদর্শন শেষে তিন ক্যাটাগরিতে (ঝুঁকিপূর্ণ, অতি-ঝুঁকিপূর্ণ ও সন্তোষজনক) ভবনগুলোর অগ্নিঝুঁকির অবস্থা নিরুপণ করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ২ হাজার ৪৯১টি ভবন এবং অতি-ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৩১২টি ভবনকে চিহ্নিত করা হয়।
দেশের ৮টি বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় পরিদর্শন করা ২ হাজার ৩০১টি শিল্প কারখানার মধ্যে ৬৫৯টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৮৭টি অতি-ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ ছাড়া ১ হাজার ১১টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৭৩টি এবং অতি-ঝুঁকিপূর্ণ ৬৫টি; ৭৩৩টি রেস্টুরেন্টের মধ্যে ৪০৬টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩৯টি অতি-ঝুঁকিপূর্ণ; ২ হাজার ১৩টি শপিংমল-মার্কেটের মধ্যে ৯০২টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১১৯টি অতি-ঝুঁকিপূর্ণ; ৫৬২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫১টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২টি ভবন অতি অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কয়েক দফায় নোটিশ পাঠালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কোনো কোনো ভবনের সামনে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে সাইনবোর্ডও। তারপরও অগ্নিঝুঁকি নিয়েই ভবনগুলোতে চলছে কার্যক্রম। ফলে যে কোনো সময়ে বড় ধরনের বির্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের অভিযোগ পেলে যাচাই শেষে নোটিশ পাঠানো হয়। পাশাপাশি ভবনগুলো যে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ, তা জানিয়ে রাজউক-সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে নোটিশের অনুলিপি দেওয়া হয়। তবে আইনি ক্ষমতা না থাকায় জরিমানা বা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অভাব এবং অগ্নিপ্রতিরোধ আইন-২০০৩ এর বিধিমালা স্থগিত থাকায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশে ২ হাজার ৮১২টি ভবন ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে, যার মধ্যে ৩১২টি অগ্নিবোমা হিসেবে চিহ্নিত। নোটিশ দেওয়ার পরও ভবন মালিকরা উদাসীন থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার দৈনিক আমাদের সময়কে জানান, অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মালিকদের নোটিশ করা হলেও সরাসরি জরিমানা বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসের নেই। জেলা অফিস বা সিটি করপোরেশনের কাছে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য আবেদন করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করতে হয়। আইন সংশোধন করে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিলে ভবন মালিকদের সচেতন করা এবং অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ সহজ হতো।
একাধিক ফায়ারম্যানদের মতে, অগ্নিনির্বাপণে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ঢাকার সরু রাস্তা, উৎসুক জনতার ভিড় এবং ডিশ ও ইন্টারনেটের তার। অনেক ভবনে পানির সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং বহুতল ভবনের জন্য প্রয়োজনীয় সিঁড়ি নেই। জলাধার না থাকায় জরুরি পানি সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও সরঞ্জাম ব্যবহারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অগ্নিনির্বাপণে সময় নষ্ট হয়।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম