ভোলার গ্যাস এলএনজি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের উদ্যোগ

লুৎফর রহমান কাকন
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ভোলার গ্যাস এলএনজি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের উদ্যোগ

দেশে তীব্র গ্যাস সংকটে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ জেলা ভোলার গ্যাসই এখন সরকারের কাছে অন্যতম ভরসা। জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে পাইপলাইনের যোগাযোগ না থাকায় ভোলার এই বিশাল গ্যাসক্ষেত্র দেশের অর্থনীতিতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। যে কারণে গ্যাস সংকট কাটাতে ভোলার গ্যাস দ্রততম সময়ের মধ্যে এলএনজি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি পেট্রোবাংলা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দ্রুততম সময়ে ভোলা থেকে প্রতিদিন অন্তত ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এলএনজি করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার। সরকারের পরিকল্পনাধীন এই ৬০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসি একাই ২০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি করে গ্রিডে দিতে আগ্রহী। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের সঙ্গে আলোচনাও করছে। ইতোমধ্যে ইন্ট্রাকো সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে ভোলা থেকে গ্যাস সিএনজি করে গাড়িতে এনে নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরের বিভিন্ন কোম্পানিতে সরবরাহ করছে।

জানা গেছে, ভোলার কূপগুলো থেকে দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করা সম্ভব। তবে ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় অব্যবহৃত পড়ে আছে এই গ্যাস। সেখানে শুধু দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সামান্য গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। ২০২১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ভোলায় পাওয়া প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজিতে (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) রূপান্তরিত করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পরিকল্পনা করে। এই গ্যাস কিভাবে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যায় সে বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে জ¦ালানি বিভাগ ২০২১ সালেই বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশনকে (পেট্রোবাংলাকে) চিঠি দিয়েছিল।

জানা গেছে, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপজেলা ভোলায় আবিষ্কৃৃত গ্যাস মূলত ছোট একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ ছাড়া তেমন কাজে লাগছে না। অথচ সংকট কাটাতে বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল এলএনজি গ্যাস আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে হচ্ছে। ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির ওই চাপ সামলাতে জ¦ালানি বিভাগ হিমসিম খাচ্ছে। যে কারণে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের চিন্তা করছে নীতিনির্ধারকরা।

অন্যদিকে ভোলার গ্যাসক্ষেত্র থেকে সিএনজি (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) আকারে দৈনিক আরও ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আনতে চায় ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এনে ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় সরবরাহ করছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সেমিনারে ইন্ট্রাকোর পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার চাইলেই আগামী ৬ মাসের মধ্যে দৈনিক গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা বেড়ে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট হবে। সেক্ষেত্রে জাতীয় গ্রিডে বা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরাসরি গ্যাস সরবরাহ করা হলে আগের চেয়ে দাম কিছুটা কম পড়বে।

ইন্ট্রাকো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রিয়াদ আলী বলেন, দেশে গ্যাস সংকট থাকার পরও পাইপলাইনের অভাবে ভোলায় আবিষ্কৃত গ্যাস পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সেজন্য আমরা ওই গ্যাস সিএনজিতে রূপান্তর করে বিশেষ পরিবহনের মাধ্যমে এনে ঢাকা এবং আশপাশের কারখানায় সরবরাহ করছি।

শাহবাজপুর ও ভোলা দুই গ্যাসক্ষেত্রে মজুত রয়েছে ২ দশমিক ০৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্থানীয়ভাবে এর চাহিদা ৭০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রায় ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অব্যবহৃত থাকে। কিন্তু পাইপলাইন নির্মাণ না হওয়ায় ঢাকা, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহের জন্য গত বছরের ২১ মে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) সঙ্গে চুক্তি করে ইন্ট্রাকো। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ইউনিট (এক হাজার ঘনফুট) গ্যাস ১৭ টাকা দরে কিনে ৪৭ টাকা ৬০ পয়সায় শিল্পকারখানায় বিক্রি করবে ইন্ট্রাকো। ওই চুক্তির পর গত বছরের ২১ ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ১৮টি কারখানায় এই গ্যাস সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ভোলা থেকে এনে এখন পর্যন্ত ৯ কোটি টাকার গ্যাস বিক্রি করা হয়েছে। যদিও প্রথম পর্যায়েই বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। ২০ মিলিয়ন ঘনফুটের প্রসেসপ্লান্ট তৈরিতে বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা।

ইন্ট্রাকোর এমডি বলেন, অনেক ঝুঁকি নিয়ে এখানে বিনিয়োগ করেছি আমরা। বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি করে প্রায় ৫ টাকা লোকসান হচ্ছে। কিন্তু গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা বৃদ্ধির পর এই লোকসান আর থাকবে না। সেজন্য আমরা আরও ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজি আকারে আনতে যে অবকাঠামো নির্মাণ করা দরকার সেই কাজ শুরু করেছি। সরকার চাইলে আগামী জুন মাস নাগাদ ভোলার গ্যাস সরবরাহ করা যাবে বলে আশা করছি। সিএনজি আকারে গ্যাস সরবরাহের কাজ বিশেষ আইনে তারা পেলেও বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ মিলিয়ন গ্যাস সরবরাহে দরপত্রের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে সরবরাহ করতে রাজি ইন্ট্রাকো। সেমিনারে ইন্ট্রাকোর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী এবং মহাব্যবস্থাপক (এডমিন) কমান্ডার (অব.) আবু সাইদ ভোলা থেকে গ্যাস আনার নানা কারিগরি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেন। আরও বক্তব্য দেন ইন্ট্রাকোর চিফ অপারেটিং অফিসার এহসানুল হক পাটোয়ারি, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) মোমিন মোল্লাহ প্রমুখ।

কর্মকর্তারা জানান, দ্বিতীয় পর্যায়ে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম্প্রেসন এবং পরিবহনের লক্ষ্যে ইন্ট্রাকো ভোলার বোরহানউদ্দিনে ১০৬ শতক জমির ওপর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এ ছাড়া কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় কম্প্রেসর কেনার জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমানে উৎপাদনের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া ইন্ট্রাকো ইতোমধ্যে সুন্দরবন গ্যাস অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার ১০ ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ লাইন স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে এবং মূল্যায়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইন্ট্রাকো বলছে, ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ভোলা হতে সরাসরি খুলনায় পরিবহন করে খুলনাস্থ ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবারহ করতে পারবে তারা। ওই এলাকায় তিনটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাসের অভাবে বন্ধ আছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিশাল নদী পেরিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা কঠিন ও ব্যয়বহুল হলেও সেই গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দেওয়ার উপায় খুঁজছে কর্তৃপক্ষ। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, ভোলায় প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট টিসিএফ গ্যাস আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) ধারণা করছে ভোলায় আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বীপজেলা হওয়ায় সেখানে তেমন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। ফলে গ্যাসের ব্যবহারও নেই। ভোলায় উত্তোলন করা গ্যাসের মধ্যে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার হচ্ছে ৫ এমএসসিএফডি গ্যাস।

ভোলায় গ্যাস আছে, এমন প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৫২ সালে। এরপর ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত জরিপ করে গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে শাহবাজপুর চিহ্নিত করা হয়। পাকিস্তান সেল অয়েল কোম্পানি সিঙ্গেল কনডাকটেড ২ডি সিসমিক জরিপ করে। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪-৭৫ সালে ফেইস-২ প্রকৃত সিসমিক জরিপ করা হয়। ফেইস-৩ এ ১৯৮৭ সালে ফের সিসমিক জরিপ করে। ওই জরিপ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৪ সালে শাহবাজপুর-১ গ্যাসক্ষেত্রে খনন শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে উত্তোলন করা গ্যাসে আগুন প্রজ্বলন করা হয়। এর ২৭ বছর পর বিগত সরকারের আমলে আবার উদ্যোগ নেওয়া হয় ফেইস-৪ হিসেবে নতন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করার। পরে ২০১৪-১৫ সালে বাপেক্সের তত্ত্বাবধানে ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় থ্রিডি সিসমিক জরিপ করে দুটি আলাদা গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়।