মুখ খুললেন জেনারেল মইন /

সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের অভিপ্রায়ে এ হত্যাযজ্ঞ

নিজস্ব প্রতিবেদক
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের অভিপ্রায়ে এ হত্যাযজ্ঞ

চাঞ্চল্যকর পিলখানা হত্যাযজ্ঞ নিয়ে মুখ খুলেছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ। সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের অভিপ্রায়েই বর্বরোচিত ওই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। সম্প্রতি নিউইয়র্কে একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া ভিডিও বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের তদন্ত কমিশন গঠনের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করে জেনারেল মঈন আরও বলেন, আশা করি জাতির প্রত্যাশা পূরণে গঠিত কমিশনের তদন্তে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটিত হবে। কারণ ওই হত্যাকাণ্ডের ভিকটিমরা ছিলেন বাংলাদেশের চৌকস অফিসারদের অন্যতম।

বক্তব্যে জেনারেল মইন বলেন, সেদিন একটি বৈঠকে থাকাকালীন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আমাকে কানে কানে জানান, পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে। তখন ওই সভা স্থগিত করে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আমার অফিসে এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিডিআরের ডিজির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের তাৎক্ষণিক সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি।

সরকারের অসহযোগিতায় ভেস্তে যায় ‘অপারেশন রিস্টোর অর্ডার’ : ভিডিও বক্তব্যে মঈন উ আহমেদ বলেন, পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়াই সেনাবাহিনীর ৪৬ ইনডিপেনডেন্ট পদাতিক ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেই। তারা তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করে, যার নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন রিস্টোর অর্ডার’। গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে পিএসও এফডি জেনারেল মবিনকে অবহিত করি। সকাল ৯টা ৪৭ মিনিটে বিডিআরের ডিজিকে ফোনে পাওয়া গেল। তিনি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন।

মঈন উ আহমেদ বলেন, মনে হলো সবই পরিকল্পনার অংশ। সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মোবাইল ফোনে পেলাম। এর মধ্যেই তিনি (শেখ হাসিনা) বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় আমি তাকে অপারেশনের কথা জানালে তিনি জানতে চান, কতক্ষণ সময় লাগবে ব্রিগেডকে তৈরি করতে? আমি বললাম, সাধারণত ছয় ঘণ্টা লাগে। তবে তাড়াতাড়ি করে দুই ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করা যায়। ব্রিগেডটি এক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা করে। সকাল সাড়ে ১০টায় ব্রিগেডের অগ্রবর্তী দল জাহাঙ্গীর গেট অতিক্রম করে। এ সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইলেও পাওয়া যায়নি।

যমুনায় ছিল অযাচিত ভিড়, আসেনি সিদ্ধান্ত

সাবেক এই সেনাপ্রধান উল্লেখ করেন, আনুমানিক বেলা ১২টায় পিএসও ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যমুনায় যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য, হাঁটার জায়গা নেই। মন্ত্রিসভা বৈঠক করছিল। কোনো সিদ্ধান্ত আসছিল না। আমি ভেবেছিলাম, সেখানে পৌঁছার সংবাদ জেনে তিনি আমাকে ভেতরে ডেকে নেবেন। কিন্তু তা করা হলো না। বেলা ২টার পর খবর এলো, পিলখানা থেকে একজন অফিসার পালিয়ে যমুনায় এসেছে। আমি তার কাছে ছুটে গেলাম। জানলাম যে বেশ কিছু অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে।

রাজনৈতিক সমাধানের নামে সময়ক্ষেপণ করেন শেখ হাসিনা

মঈন উ আহমেদ বলেন, মন্ত্রিসভার পর আরেকটি ছোট বৈঠক করে তিন বাহিনীর প্রধানদের ডাকেন শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের বলেন যে, রাজনৈতিকভাবে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। জানতে পারি কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম ও ব্যারিস্টার তাপস বিদ্রোহীদের একটি ডেলিগেশন নিয়ে যমুনায় আসছেন। তখন আমি তাকে (শেখ হাসিনা) বলি, বিদ্রোহীদের কোনো শর্ত মানা যাবে না। আপনি তাদের বলবেন, অফিসার হত্যা এ মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। আর একটি প্রাণও যেন না হারায়। দ্বিতীয়ত. আটক সব অফিসার এবং তাদের পরিবারকে এক্ষুণি মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত. অস্ত্র, গোলাবারুদসহ সব বিদ্রোহীকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। চতুর্থত. আমি জোর দিয়ে বলি যে, সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

বিকাল ৩টা ৪৮ মিনিটে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ জন বিদ্রোহী আলোচনার জন্য যমুনায় আসে। শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরপর উনি সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা ৬টা ৩৭ মিনিটে যমুনা থেকে পিলখানার উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখানে গিয়ে তারা ঘোষণা দেয় যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ ক্ষমার প্রজ্ঞাপন তাদের হাতে না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ করবে না। তারা পুনরায় গোলাগুলি শুরু করে।

মঈন উ আহমেদ বলেন, রাত ১২টায় তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শেখ ফজলে নূর তাপস ও তৎকালীন আইজিপি পিলখানায় যান আলোচনার জন্য এবং তাদের সঙ্গে বসেন। সাহারা খাতুন জানতেন, অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাদের মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নেননি, খোঁজখবরও নেননি।