উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভুগিয়েছে

রেজাউল রেজা
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভুগিয়েছে

আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে গত ১৫ বছরে বাজারে চলেছে লাগামহীন নৈরাজ্য। একের পর এক পণ্যে অস্থিরতা তৈরি করে ভোক্তার পকেট কেটেছে অসাধু চক্র। অন্যদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলেও প্রকৃত চিত্র আড়াল করে মূল্যস্ফীতির হিসাব কমিয়ে দেখানো হয়েছে। তাই কাগজে-কলমে যতটা না মূল্যস্ফীতি দেখানো হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি চাপে ছিল সাধারণ জনগণ। মূল্যস্ফীতির সংখ্যার আড়ালে ছিল অনেকের চাপাকান্না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে পৌঁছায়। এরপর সেপ্টেম্বর ছাড়া আগস্ট, অক্টোবর এবং সর্বশেষ নভেম্বরে তা দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত টানা দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে। নভেম্বরের হিসাবেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। অব্যাহত এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ‘নূন আনতে পান্তা ফুরায়’ দশা হয়েছে সীমিত আয়ের মানুষের। দুই অঙ্কের খাদ্য মূল্যস্ফীতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠীকে। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট ও কম খেতে বাধ্য হয়েছেন তারা। বেকায়দায় ছিলেন মধ্যবিত্তরাও। তাদের জীবনমানের পতন ঘটেছে। তবুও বাজারে থেমে ছিল না জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি। কখনও পেঁয়াজ, কখনও আলু, আবার কখনও ডিম নয়তো সবজিÑ বছরজুড়ে একের পর এক পণ্যের বাজারে ছিল নানা নাটকীয়তা।

ভালো উৎপাদন ও পর্যাপ্ত মজুত থাকা স্বত্বেও কৃষকের কাছ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে কেনা আলু খুচরায় সর্বোচ্চ ৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। পেঁয়াজের কেজি বেড়ে ১৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। এ বছর ডিম নিয়েও হয়েছে তুলকালাম। এক ডজন ডিমের দাম বেড়ে ১৮০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে পুরো বছর ধরেই কম দামের ব্রয়লার মুরগি হিসাব করে কিনতে হয়েছে নিম্ন আয়ের এবং খেটে খাওয়া পরিবারগুলোকে। সস্তার পাঙাশ, তেলাপিয়াও দামি পণ্যে পরিণত হয়েছে।

এদিকে, অতীতের মতো সয়াবিনের বোতল আবারও বাজার থেকে হাওয়া হয়েছে। পরে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর দাবির মুখে দাম বাড়ানো হলেও সরবরাহ পুরো স্বাভাবিক হয়নি। দরিদ্রের ভরসা খোলা তেলের দামও নাগালের বাইরে চলে গেছে। এ বছর সবজির বাজারেও নাকানি-চুবানি খেয়েছেন সাধারণ মানুষ। কাঁচামরিচের দাম ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

চালের বাজারেও অসাধু চক্রগুলো বছরজুড়ে সক্রিয় ছিল। পুরনো কায়দায় যৌক্তিক কারণ ছাড়াই হুটহাট দাম বাড়ানো হয়েছে। বন্যাকালীন সময়ে ত্রাণ কর্মসূচির কারণে চাহিদা বেড়ে গেলে দাম বাড়িয়ে দেয় মিলগেটগুলো। পরে তা কিছুটা কমে এলেও পরে আবার বেড়েছে। সরু চালের কেজি ৮০ টাকা এবং মোটা চালের দাম ৫৬ টাকা কেজি পর্যন্ত পৌঁছেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেই উঠে এসেছে বছরের ব্যবধানে সরু চালে ১১ দশমিক ১১, মাঝারি চালে ১৩ দশমিক ৩৩ এবং মোটা চালে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ দাম বেশি রয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের কাছে হার মেনেছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর কদমতলীর বাসিন্দা মো. মোতাহার হোসেন। তিনি বলেন, দিন হিসাবে খেটে যে আয় হয়, তা দিয়ে বাজার খরচ সামাল দেওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে মুরগি, ডিম এসব খাওয়া বাদ দিছি। জীবনধারণের অন্যান্য খরচও অনেক বেড়েছে। কোনটা রেখে কোনটা সামাল দেব, সেই হিসাব মিলাতে পারি না।

মোতাহারের মতো বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সাইফুল ইসলামও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পেরে উঠছেন না। বলেন, গত দুই-তিন বছর ধরে চাপ অনেক বেড়েছে। বেতনের টাকায় কুলাচ্ছে না। ঋণ করতে হচ্ছে।

পরিস্থিতি উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিসহ নানা উদ্যোগ নিলেও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পেরে ওঠা যাচ্ছে না। বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক কমানোসহ পণ্য সরবরাহ বাড়াতে নেওয়া হয়েছে উদ্যোগ।

অতীতে দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়লেও গত ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে যে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, এর ফলে জীবনযাত্রায় যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, করোনা মহামারির পরে যেসব কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে কেটে গেছে। অন্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ পারেনি। এর পেছনে বড় কারণ, ওই সময়ে সরকার সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তখন যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে। গত আগস্ট পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন অন্তর্বর্তী সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এখন যা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে কাজের সঙ্গতিটা এসেছে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। তাই সুফলটা অতি দ্রুত মিলবে না। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখতে হবে।

ড. জাহিদ বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনাতে অনেক ত্রুটি রয়েছে- সেটা সুস্পষ্ট। আমন ধান উঠছে কিন্তু চালের দাম বাড়ছে। এগুলো চাহিদা-জোগান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমরা পুরনো কৌশলেই আটকে আছি। বাজারে অভিযান, জরিমানা করছি। এগুলোতো আগের সরকারও করেছে। যেখানে যেভাবে হাত দেওয়া প্রয়োজন সেভাবে দিচ্ছি না। বাজারে প্রতিযোগিতারও ঘাটতি রয়েছে। শুল্ক ছাড় দেওয়া হচ্ছে কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে না। তাই পুরনো পথে হাঁটলে চলবে না। যেখানে পুলিশি কায়দা প্রয়োজন, সেখানে প্রয়োগ দেখি না। খুচরা পর্যায়ে পুলিশি কায়দায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসে না।