রক্তে রাঙানো জুলাই-আগস্ট

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
রক্তে রাঙানো জুলাই-আগস্ট

মাত্র এক মাসে হাজার হাজার মানুষের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ থেকে গ্রামগঞ্জের পথঘাট। সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনরোষের মুখে থানাসহ অধিকাংশ স্থান থেকে পুলিশ পালিয়ে যাওয়ার মতো বিরল ঘটনা ঘটে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে। সময়ের পরিবর্তনে পুলিশ থানায় ফিরেছে। পুলিশের শীর্ষপদ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ইউনিটের প্রধানকে বদলে ফেলা হয়েছে অধিকাংশ স্থানে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। হত্যা, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো লোমহর্ষক ঘটনা মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখছে। অতীতের অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে পুলিশ শুদ্ধতার জন্য কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি হিসাব

বলছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রথম ধাপের খসড়া তালিকায় ৮৫৮ জন শহীদ হন। আহত হন ১১ হাজার ৫৫১ জন। হাত, পা কিংবা চোখ হারিয়ে চিরতরে দেখার শক্তি হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের শুরুতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আমলাদের ওপর ভর করে নির্বাচনের বৈতরণী পার হয় আওয়ামী লীগ সরকার। জুলাইয়ের শুরুতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ১৭ জুলাই থেকে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর পর জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রত্যেকটি থানা ও পুলিশ স্টেশন থেকে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার পর বাহিনীতে ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়। তিন দিন পর ৯ আগস্ট থেকে সশস্ত্র বাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সহায়তায় পর্যায়ক্রমে থানাগুলো চালু হতে থাকে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় ডাকাত ও ছিনতাইকারীসহ পেশাদার অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের অপরাধ। পরে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনী মাঠে নামলেও এখনো আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকা পুলিশের মনোবল ও তৎপরতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারাগার থেকে ঢালাও অপরাধীরা বের হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতি সতর্কতার সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। যৌথ বাহিনীর জোরালো সাঁড়াশি উদ্যম নেই। যৌথ বাহিনী এমন কোনো কাজ করতে চাচ্ছে না, যেন বিতর্কিত হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যম কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ না থাকায় ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই অপরাধী চক্রগুলো সুযোগ নিচ্ছে। আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে পরিস্থিতির অবনতি হয়ে জনমনে উদ্বেগ তৈরি করছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘসময় ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হয়েছে। সেই জনরোষের কারণে পুলিশ অনেকটাই গুটিয়ে গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোটিভেশনেও মনোবল পুরোপুরি ফিরছে না। পুলিশের মনোবল দুর্বল হয়ে যাওয়ায় অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকাসহ সারা দেশে সংঘবদ্ধ ডাকাতি, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বাড়ছে। ৫ আগস্ট-পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুটে নেওয়া অস্ত্র বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশও (ডিএমপি) ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আমার কাছে যে রিপোর্ট এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ছিনতাই অনেক বেড়ে গেছে। বেশির ভাগ ছিনতাই হচ্ছে মোবাইল ফোন। বাসে যাত্রী বসে থাকে, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনতাই হচ্ছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগী হচ্ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও কর্মসংস্থানের অভাবের ফলেও আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠনসহ সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধ ঘটাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো গেলে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ নিয়ন্ত্রণও সহজ হবে।

জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বছরের শুরু থেকে কয়েকটি অপরাধ ও দুর্ঘটনা আলোড়ন তোলে। এর মধ্যে ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নারী, শিশুসহ ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। গত ১২ মে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে কৌশলে কলকাতা নিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর মরদেহ টুকরা টুকরা করা হয়। গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীদের সংঘর্ষের সময় চট্টগ্রামে আইনজীবী ও সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম (৩৫) হত্যার ঘটনায় উত্তাল হয় দেশ। বছরের শেষে এসে ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের হাইমচরে সারবাহী জাহাজে সাত খুনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়।