অ্যানালগ সংরক্ষণে ঝুঁকিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দলিল

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অ্যানালগ সংরক্ষণে ঝুঁকিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দলিল

বাংলাদেশ সচিবালয়ে আগুনে পুড়েছে কয়েক হাজার রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি। পুড়ে গেছে দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অসঙ্গতির প্রমাণও। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। সচিবালয়ের পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে যাওয়ার পর ঝুঁকিতে রয়েছে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও। সুযোগ থাকার পরও নথি ডিজিটাইজেশন করেনি সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো। সব রকম ডিজিটাইশনের সুযোগ থাকার পরও নথি অ্যানালগ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা ঝুঁকি যেমন বাড়ে, তেমনি নথি হারিয়ে যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তিও চরম বাড়ে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানালগ নথি যেভাবে নষ্ট করে ফেলা সম্ভব, ডিজিটাল নথির ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। তাই অপরাধ-দুর্নীতি আড়াল করতে সরকারি কর্তারা নথি ডিজিটাইজেশনের বিপক্ষে থাকেন।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, গত সরকারের সময় সবকিছুই ডিজিটাল হয়েছে। তবে কিছু মন্ত্রণালয়ের নথি ডিজিটাল হলো না কেন, এটা একটা ব্যাপার। বিগত সরকার সব মন্ত্রণালয়ে ই-নথি ও ডি-নথি সিস্টেম চালু করেছিল। এটার জন্য বিশেষ কিছুর দরকার হয় না। লাগে শুধু মোবাইল, কম্পিউটার আর ইন্টারনেট। এটা শুধু উদ্যোগের অভাব। সব মন্ত্রণালয়ের ডি-নথি আছে। এখন কেউ যদি সেটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ না করে, তা হলে সেটার দায় তো তারই। এটা হতে পারে যে, ডিজিটাল নথি সরংক্ষণ করা হলে সেটি নষ্ট করা যায় না। আর অ্যানালগ নথি থাকলে সহজে নষ্ট করে ফেলা যায়। উদাসীনতা কিংবা অপরাধ আড়ালে রাখতে নথিগুলো ডিজিটাল করা হয়নি।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর মধ্যে দুর্নীতির প্রমাণ, প্রকল্পের অর্থ লোপাটসহ নানা দলিলপত্রও রয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নথির কার্যক্রম অনলাইনে থাকার কারণে সেটা আমরা রিকভার (পুনরুদ্ধার) করতে পারব। কিন্তু স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পুরোটাই অ্যানালগভাবে হয়, পুরোটাই ফাইলে হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,

সাধারণত সরকারি নিয়োগ, পদায়নের রেকর্ড ভালোভাবে রাখা হয়। তবে সরকারি বহু চিঠিতেই স্মারক নম্বরের ক্রমধারা বজায় রাখা হয় না। সরকারি সংস্থাগুলোতে দুর্নীতি টিকে থাকার সঙ্গে দুর্বল নথি সরংক্ষণের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অপরাধীচক্র কাগজপত্র গায়েব করে দেয়। সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করেও কাগজপত্র খুঁজে না পাওয়ার নজির রয়েছে। ভালোভাবে নথিপত্র সংরক্ষণের অভাব পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও দুর্নীতিমুখী করে তোলে।

সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, কিছু নথি হয়তো আবার সৃজন করা যাবে। কিছু জিনিস তো পাওয়া যাবে না। যেমন নোট শিটের মধ্যে কার কী কথা-মন্তব্য ছিল, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সাথে যেসব চুক্তি, টেন্ডার ডকুমেন্ট এ সমস্ত কাগজপত্র সৃজন করা যাবে।

সাবেক এই সচিব বলেন, পৃথিবীতে এখন নথি ডিজিটাল উপায়ে সরংক্ষণ করা হচ্ছে। তবে পৃথিবীর কোনো দেশেই নথিপত্র পুরোপুরি কাগজবিহীন নয়। এবার তো নথি পুড়ে গেল, আমাদের সময় আগের নথি হারিয়ে যেত, চুরি হয়ে যেত। সেগুলো আমরা নতুন করে সৃজন করতাম। এখনও নথি সৃজন করার সুযোগ আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু চিঠি কিংবা নথিপত্র নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে জমির রেকর্ড এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে। ভূমি রেকর্ড ঠিক থাকলে ভূমিসংক্রান্ত মামলাজট কমে যেত। জবরদখলের সুযোগ থাকত না। সরকারি আমলাতান্ত্রিক নথিপত্র যদি ডিজিটাইজ না করলে, বাংলাদেশের দুর্নীতি প্রতিরোধের চেষ্টা গতিশীল হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে সাড়ে ১৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। তবু ডিজিটাল সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্নীতি কমানো, আইসিটি সেবা রপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে দেশ। আইসিটি বিভাগের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভাগটি ৫৩টি প্রকল্প ও ৩৪টি কর্মসূচিতে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর বাইরেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ডিজিটাইজেশন-সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়েছে। তার পরও মন্ত্রণালয়ের সব নথিপত্র ডিজিটাইজেশন করতে পারেনি।