কণ্ঠজাদুতে উন্মাতাল আর্মি স্টেডিয়াম

অভ্যুত্থানের প্রতিধ্বনি

চপল মাহমুদ
২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কণ্ঠজাদুতে উন্মাতাল আর্মি স্টেডিয়াম

কণ্ঠের জাদুতে হাজারো সংগীতপিপাসু দর্শকের মনে গভীর মুগ্ধতার আবেশ ছড়ালেন রাহাত ফতেহ আলী খান। গতকাল শনিবার কনকনে শীতের রাতে ঝলমলে আলোয় সুরের ঝংকারে মেতে ওঠে রাজধানী আর্মি স্টেডিয়াম। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় আয়োজিত ইকোস অব রেভুলিউশন বা অভ্যুত্থানের প্রতিধ্বনি শীর্ষক কনসার্টের ঢাকার সংগীতপিপাসুরা উপভোগ করলেন সুরের এই জাদুকরের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। 

রাত ৯টার পর মঞ্চে ওঠেন পাকিস্তানি সংগীতশিল্পী রাহাত ফতেহ আলী খান। এই সুফিশিল্পী কাওয়ালি ও বলিউড সিনেমার গানের সংমিশ্রণে ভিন্ন এক আবহ তৈরি করেন শীতের আর্মি স্টেডিয়ামে। শিল্পী যেমন হৃদয় উজাড় করে কণ্ঠ থেকে সুরের সুধা ছড়িয়েছেন। ঠিক তেমনই দর্শক শ্রোতারাও মুহুর্মুহু করতালিতে স্টেডিয়াম প্রকম্পিত করে শিল্পীকে অভিনন্দনে সিক্ত করেছেন। ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নন-ফিল্ম মিউজিক ভিডিও ‘ব্যাক টু লাভ’  অ্যালবামের ‘জরুরি থা’ গানটি এক বিলিয়ন ভিউ অতিক্রম করার পর শিল্পীকে দশ বছর আগে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করে। এক দশকেও সেই গানটির আবেদন একটুও কমেনি। জরুরি থা গানটির প্রথম লাইন শেষ হওয়ার আগেই ভক্তদের উল্লাস আর উচ্ছ্বাসের বাঁধভাঙা জোয়ারে নাচের উন্মাদনায় আবৃত হয়ে পড়ে গোটা আর্মি স্টেডিয়াম। এ ছাড়াও তিনি আরও কিছু গান গেয়ে শোনান ঢাকার দর্শকদের।

এই কনসার্টের বিনা পারিশ্রমিকে গাইলেন এই রাহাত ফাতেহ আলী খান। তার পারিশ্রমিকের অর্থ জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে দিতে বলেছেন তিনি। তাকে ছাড়াও কনসার্টের মঞ্চ মাতান দেশি ব্যান্ড আর্টসেল, চিরকুট, আফটারম্যাথ ও সিলসিলা। এর বাইরে ছিল জনপ্রিয় র‌্যাপ সংগীতশিল্পী সেজান ও হান্নানের পরিবেশনা। সংগীত ছাড়াও কনসার্ট ইভেন্টে জুলাই বিপ্লব সংক্রান্ত গ্রাফিতি প্রদর্শনী, মঞ্চনাটক, মুগ্ধ ওয়াটার জোনসহ বিভিন্ন কর্নার রাখা হয়। কনসার্টের উপস্থাপনায় ছিলেন জুলহাজ জুবায়ের ও দীপ্তি চৌধুরী। যৌথভাবে এ কনসার্টের আয়োজন করে ‘স্পিরিটস অব জুলাই’ প্ল্যাটফর্ম ও স্কাইট্র্যাকার লিমিটেড। কনসার্টে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত পরিবারের শতাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। 

গতকাল বিকাল ৪টায় সিলসিলা ব্যান্ডের কাওয়ালি দিয়ে শুরু হয় কনসার্ট। এর আগে বেলা ২টায় দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামের গেট। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা নামতেই বদলে যায় দৃশ্যপট। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে শুরু করেন দর্শনার্থীরা। দেখতে দেখতেই পুরো স্টেডিয়াম চলে যায় তরুণদের দখলে।

সিলসিলা ব্যান্ডের কাওয়ালি পরিবেশনার পর মঞ্চে আসেন ‘আওয়াজ উডা’ গানের জন্য পরিচিত র‌্যাপার হান্নান। শুরুতে র‌্যাপ গানটি পরিবেশন করেন তিনি। এরপর মঞ্চে আসেন আরেক আলোচিত র‌্যাপার সেজান। মঞ্চে ‘কথা ক’ গানটি গেয়ে শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া ফেলেন এই র‌্যাপার। একটু বিরতির পর সাড়ে ৫টার মঞ্চে আসে রক ব্যান্ড ‘আফটারম্যাথ’। মাইক্রোফোন হাতে ব্যান্ডের ভোকালিস্ট নাভিদ ইফতেখার চৌধুরী শ্রোতাদের বলেন, প্রথমবারের মতো আর্মি স্টেডিয়ামে গাইছি। এবার স্বপ্ন পূরণ হলো। শুরুতেই ব্যান্ডটি গাইলেন তরুণদের মধ্যে আলোচিত গান ‘অধিকার’। এরপর ‘উৎসর্গ’, ‘মাটির রোদ’সহ আরও কয়েকটি গান পরিবেশন করেছে আফটারম্যাথ। এরপর মঞ্চে ওঠেন ‘চিরকুট’ ও ‘আর্টসেল’। কনসার্টের শেষ আকর্ষণ হিসেবে রাত ৯টায় মঞ্চে আসেন রাহাত ফতেহ আলী খান।

এর আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বক্তৃতা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম, জুলাই অভ্যুত্থানে হাত হারানো গাজী আতিক, শহীদ মীর মুগ্ধের ভাই মীর স্নিগ্ধ ও শহীদ আহনাফ ফাইয়াজের মা। সারজিস বলেন, খুনি হাসিনার গুলিতে আমাদের ভাইয়েরা নিজেদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে নতুন স্বাধীনতা এনে দিয়ে আমাদের ফ্যাসিবাদের কবল থেকে রক্ষা করেছেন। যার কারণে তাদের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। 

মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসার লক্ষ্যেই এই ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন কখনো নগদ টাকা গ্রহণ করে না। বিকাশ, রকেট, নগদ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ফাউন্ডেশনের তহবিল গঠন করা হয়ে থাকে। আমরা গণ-অভ্যুত্থানকে যেভাবে সফল করেছি, সংস্কার প্রক্রিয়াকেও সেভাবে সফল করব। শহীদ আহনাফ ফাইয়াজের মা বর্তমান সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমাদের আশপাশে স্বৈরাচারের যেসব দোসররা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। 

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তার জন্য এ কনসার্টের আয়োজন করা হয়। এই কনসার্ট থেকে আয় হওয়া সব অর্থ শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবার নিয়ে কাজ করা কল্যাণমূলক সংস্থা ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ দেওয়া হবে। এদিকে, এই কনসার্টের জন্য আর্মি স্টেডিয়ামের কোনো ভাড়া নেয়নি সেনাবাহিনী। আন্দোলনে আহত-নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে সহায়তার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই আয়োজন হওয়ায় সেনা ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড স্টেডিয়ামের সম্পূর্ণ ভাড়া মওকুফ করে দেয়। 

এদিকে কনসার্টে বেলা ২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এয়ারপোর্ট, কুড়িল ও বনানী র‌্যাম্প দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারকারীদের জন্য টোল মওকুফ করা হয়। সেই সঙ্গে জনদুর্ভোগ বিবেচনায় জাহাঙ্গীর গেট ও জিয়া কলোনির গেট বেলা ২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খুলে রাখা হয়। এ ছাড়া কনসার্টের টিকিটে আরোপিত ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক মওকুফ করে সরকার।

কনসার্টে ভিআইপি টিকিটের মূল্য ছিল ১০ হাজার, সামনের সারির টিকিট ৪ হাজার ৫০০ এবং সাধারণ ২ হাজার ৫০০ টাকা। তবে শিক্ষাার্থীদের জন্য ছিল ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত বিশেষ ছাড়। কনসার্ট চলে তার ১১টা পর্যন্ত।