না ফেরার দেশে হাসান আরিফ

নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
না ফেরার দেশে হাসান আরিফ

অন্তর্বর্তী সরকারের বিমান ও পর্যটন এবং ভূমি উপদেষ্টা এএফএম হাসান আরিফ (৮৫) মারা গেছেন। গতকাল শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার ছেলে মোয়াজ আরিফ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া প্রয়াত উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস) নাছির উদ্দিন জানান, হাসান আরিফ শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন; জ্বরও ছিল। দুপুরে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে চেয়ার থেকে পড়ে যান তিনি। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে, অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। উপদেষ্টা হাসান আরিফের প্রথম জানাজা গতকাল বাদ এশা ধানমন্ডি ৭ নম্বরে বায়তুল আমান জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা জানাজায় অংশ নেন।

দ্বিতীয় জানাজা আজ শনিবার বেলা ১১টায় হাইকোর্ট চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে। বিদেশে অবস্থানরত তার মেয়ে দেশে ফেরার পর দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। আগামীকাল ২২ ডিসেম্বর রাত সাড়ে দশটায় তার মেয়ে দেশে পৌঁছার কথা রয়েছে।

হাসান আরিফের মৃত্যুতে পৃথক শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, তার মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। রাষ্ট্রপতি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

পৃথক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাসান আরিফের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ আইনজীবী, যিনি অন্তর্বর্তী সরকারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। হাসান আরিফের কয়েক দশকের জনসেবার কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা ও মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।

গতকাল বিকালে দুবাই থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে বহনকারী একটি ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাসান আরিফের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। প্রয়াত উপদেষ্টাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে ছুটে যান ড. ইউনূস।

এদিকে, হাসান আরিফের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, আইনের শাসনের ভাবনায় হাসান আরিফের অভিমত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। গতকাল এক শোকবার্তায় তিনি মরহুমের শোকার্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানান। 

অন্যদিকে, উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে যান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। সেখানে তিনি হাসান আরিফের পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের প্রতি সমবেদনা জানান। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, হাসান আরিফ কেবল একজন স্বনামধন্য আইনজীবীই ছিলেন না, তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। এ সময়ে তাকে খুব প্রয়োজন ছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন সুহৃদকে হারিয়েছি। দেশ হারিয়েছে একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। তার শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। 

এ ছাড়াও হাসান আরিফকে শেষবারের মতো দেখতে যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদসহ ভক্ত-স্বজনরা।

হাসান আরিফের মৃত্যুতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, বস্ত্র ও পাট এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ?্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া প্রমুখ। 

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এক শোকবার্তায় বলেছেন, একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবেই সমাদৃত ছিলেন হাসান আরিফ। তার মৃত্যুতে দেশ এক আলোকিত সন্তানকে হারাল।

যৌথ শোকবার্তায় জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের রাজনৈতিক প্রধান আনিসুর রহমান, সাংগঠনিক প্রধান মোহাম্মদ শাফিউর রহমান ও সদস্য সচিব হাসান মোহাম্মদ আরিফ শোক প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও দেশের বিশিষ্টজনরা শোক প্রকাশ করেছেন। 

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮২ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৮৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত হাসান আরিফ সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৮৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

হাসান আরিফ ১৯৪১ সালের ১০ জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর স্নাতক এবং এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ঢাকায় এসে বাংলাদেশ হাইকোর্টে কাজ শুরু করেন। ১৯৭০ সালে তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ, নির্মাণ সালিশ, বাণিজ্যিক সালিশ, অর্থ, ব্যাংকিং এবং সিকিউরিটিজ বিষয়, করপোরেট, বাণিজ্যিক ও ট্যাক্সেশন বিষয়, সাংবিধানিক আইন বিষয়, পাবলিক আস্বাদন, আরবিট্রেশন এবং বিকল্প বিরোধ সমাধানের অন্যান্য পদ্ধতি নিয়েও কাজ করছেন তিনি।