গুপ্তহত্যা ও টার্গেট হামলার আতঙ্কে আন্দোলনকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
গুপ্তহত্যা ও টার্গেট হামলার আতঙ্কে আন্দোলনকারীরা

সরকারের পটপরিবর্তনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়া একাধিক শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। শিকার হচ্ছেন গুপ্তহত্যা ও টার্গেট হামলার। তাদের ওপর নজরদারি ও ফোনে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগও করছেন। বলছেন, হত্যার উসকানি দিয়ে অনলাইনে বিভিন্ন বার্তাও দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে গুপ্তহত্যা ও টার্গেট হামলার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেক শিক্ষার্থী। ইনকিলাব মঞ্চ বলছে, জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে সক্রিয় পাঁচ শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে সংগঠনটি।

অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, এলাকাভেদে মানুষ নানা ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছেন। একা চলাফেরায় ভয় পাচ্ছেন। অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা হিসেবে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেওয়ার অপচেষ্টা এটা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ড পূর্ণমাত্রায় স্বাভাবিক না হওয়ায় অপরাধীরা এমন সুযোগ নিচ্ছে। অপরাধীদের প্রতিরোধ ও আইনের আওতায় আনতে না পারলে এটা বন্ধ হবে না। তিনি যোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে যৌথ বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।

জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছাত্র-জনতার নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়েছে জানিয়ে গতকাল ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হচ্ছে। আগামী শনিবারের (আগামীকাল) মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা না হলে ইনকিলাব মঞ্চ রবিবার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে গিয়ে অনশন করবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত ১২ ডিসেম্বর গাজীপুরে ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির তানজীর হোসেন শিহানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন নারায়ণগঞ্জে এআইইউবির শিক্ষার্থী সীমান্তকে ছুরিকাঘাত করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি মারা যান। সবশেষ, গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে

পূর্বাচলের ২ নম্বর সেক্টরের লেক থেকে সুজানা আক্তার নামে এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর সেখান থেকে সাইনুর রশিদ ওরফে কাব্য নামে আরেক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন চট্টগ্রামে জসিম উদ্দিন নামে একজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। নিহতরা জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। গত বুধবার রাতে ফরিদপুরের সদরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থী কাজী সাইফুল ইসলামের (২৪) ওপর অতর্কিত হামলা হয়েছে। তিনি নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।

জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে হত্যার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আমরা যে কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডের আসামি ধরতে বদ্ধপরিকর। বিষয়গুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। তিনি বলেন, এআইইউবির শিক্ষার্থী ওয়াজেদ সীমান্ত হত্যার ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছি। ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার ছাড়াও অন্য অপরাধীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ খুবই তৎপর। আমরা কোনো অপরাধীকে ছাড় দিচ্ছি না। হত্যাকারী যে-ই হোক, আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

পুলিশের এই এআইজি আরও বলেন, অপরাধ সংঘটনের পর আমরা আসামিদের আইনের আওতায় আনছি। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, সেই প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিংয়েও আমরা জোর দিয়েছি।

এদিকে গত বুধবার বিকালে রাজধানীর বাংলামোটরে এক সংবাদ সম্মেলনে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেছিলেন, আমরা দেখছি নানা জায়গায় শিক্ষার্থীরা গুপ্তহত্যার শিকার। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনের আগে এই ধরনের গুপ্তহত্যাকাণ্ডে দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। বাসাবাড়িতে গুপ্ত হামলার ঘটনায় একাধিক নেতাকর্মী নিহত হন। মাথায় হেলমেট, মুখে মুখোশ পরে নম্বর প্লেটবিহীন মাইক্রোবাস অথবা মোটরসাইকেলে রাতের অন্ধকারে এসব গুপ্ত হামলা চালানো হয়। ২০২৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে নওগাঁ শহরের রাজাকপুর এলাকায় বাড়ি ফেরার পথে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা কামাল আহমেদকে মুখোশধারীরা কুপিয়ে হত্যা করে। সেই সময় পাবনা, নাটোর, নওগাঁ ও রাজশাহীতে কমপক্ষে ১৮টি গুপ্ত হামলার ঘটনা ঘটে। রাজশাহীর ৩টি হামলার ঘটনায় জামায়াতের দুজন গুপ্ত হত্যার শিকার হন। প্রায় এক বছর পর একই স্টাইলে গুপ্তহত্যা ও টার্গেট করে হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।

একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, অনলাইন ভিডিওর মাধ্যমে এবং ফোন করেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই স্বাভাবিক চলাফেরায় তারা এখন ভয় পাচ্ছেন। এর মধ্যে অনলাইনে ভাইরাল একটি ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে বলতে দেখা যায়, দালালদের হত্যা করতে হবে। এখন খুঁজে খুঁজে প্রতিটি গ্রাম ও মহল্লায় হত্যার মিশন হওয়া উচিত।

ইব্রাহীম খলিল শাওন নামে এক শিক্ষার্থী তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। আমার মনে হলো অনেকক্ষণ যাবৎ একজন লোক আমার পেছন পেছন আসছেন। সন্দেহ হলো তখন, যখন আমি ফুটপাতের একটা দোকানে একটা জিনিস কিনতে দাঁড়িয়েছি এবং লোকটাও একটু পাশেই দাঁড়িয়েছেন। আমি যেই গলিতে বাঁক নিচ্ছি, উনিও একই দিকে বারবার মুভ করছেন এবং প্রতিবারই আমার থেকে অল্প দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছেন। এরপর ভার্সিটিতে তেমন একটা যাইনি। বাইরে বের হলেও কয়েকজন ফ্রেন্ডকে লোকেশন শেয়ার করে রাখি। মোহাম্মদপুর, শাহবাগ ও তেজগাঁও থানায় অজ্ঞাত নামানুসারে ৩টা জিডি করেছি। তিনি আরও লিখেছেন, জুলাই আন্দোলনের কিছু সেনসিটিভ তথ্য, উপাত্ত ও ছবি আমার কাছে আছে। এ জন্যই বোধ হয় আমার পেছনে এতটা উঠেপড়ে লেগেছে। অপরিচিত নম্বর থেকে হুমকি-ধমকি তো বহু আগেই পেয়েছি। এখন জুলাই আন্দোলনের একটা বইয়ের কাজ শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকব কিনাÑ সেটাও জানি না।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম নগরীতে ছাত্রদলকর্মী জসিম উদ্দীনকে মঙ্গলবার রাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাজবির হোসেন শিহান, এআইইউবির শিক্ষার্থী মো. ওয়াজেদ সীমান্ত দুর্বৃত্তদের হাতে খুনের শিকার হন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরাজিত শক্তি এ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের টার্গেট করে গুপ্তহত্যার মিশনে নেমেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জীবনের নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পর পর কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী একইভাবে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাদের জামিনের বিরোধিতা করে ফ্যাসিবাদের দোসরদের সুষ্ঠু বিচার ও পরাজিত শক্তির গুপ্তহত্যার বিচারের দাবিতে আদালত ঘেরাও ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাদের ওপর হামলা হয়েছিল, তাদের এক সপ্তাহ পর্যন্ত নথিপত্র সরবরাহ করা হয়নি। অথচ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জামিন দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করা হচ্ছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, গুপ্তহত্যা ও টার্গেট হামলার ঘটনায় অপরাধী চিহ্নিত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে। ভুক্তভোগীরা অনেক সময় ভয় ও হয়রানির কারণে মামলা করেন না। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা ও তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।