বিদেশি কোম্পানির অনীহায় চিন্তিত পেট্রোবাংলা
সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান
সমুদ্রসীমা নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ ছিল বাংলাদেশের। আন্তর্জাতিক আদালতে সেই বিরোধ নিষ্পত্তি হয় ভারতের সঙ্গে ২০১২ সালে এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২০১৪ সালে। এর ফলে দেশের মূল ভূখণ্ডের প্রায় সমান সমুদ্র অঞ্চলের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। তবে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির কয়েক বছরের মধ্যেই মিয়ানমার ও ভারত বাংলাদেশের সীমানাঘেঁষা তাদের সমুদ্র ব্লকগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন ও বাজারজাতকরণে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। গত এক যুগে কয়েক বার চেষ্টা করেও সমুদ্র ব্লকগুলো ইজারা দিতে আন্তর্জাতিক কোনো কোম্পানির সাড়া পায়নি বাংলাদেশ। সম্প্রতি সর্বশেষ আন্তর্জাতিক দরপত্রেও কোনো সাড়া মেলেনি। বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বেগের মধ্যে আছে পেট্রোবাংলা। বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য সমুদ্র বিনিয়োগকে আকর্ষণীয় করার পরও কেন কোনো দরপত্র জমা পড়েনি, সেটা খতিয়ে দেখতে এবং নিজেদের পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি গঠন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, সংস্থাটির এক পরিচালককে (পিএসসি) প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত কমিটিকে এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র কিনলেও জমা না দেওয়ার কারণ জানতে কমিটি গঠন করেছে পেট্রোবাংলা। আমরা পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।
সমুদ্র অঞ্চলে ২৪টি ব্লকে (গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯টি) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হয় চলতি বছরের ১১ মার্চ। দরপত্র জমার জন্য ৬ মাস (৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সময় দেওয়া হয়। সময় শেষ হওয়ার আগেই কেউ কেউ ৬ মাস সময় বাড়াতে চাইলেও ৩ মাস বাড়িয়ে ৯ ডিসেম্বর
করা হয়। মার্কিন কোম্পানি এক্সোন মবিলসহ ৭টি আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা কোম্পানি দরপত্র কিনেছিল, ২টি কোম্পানি পেট্রোবাংলা থেকে ডাটাও কিনেছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউই দরপত্র জমা দেয়নি।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
পেট্রোবাংলার চেয়ার?ম্যান বলেন, সাতটি কোম্পানি দরপত্র কিনলেও কেন জমা করল না তার কারণ জানতে কমিটি করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বানের পর সভা, সেমিনার ও বৈঠক হয়েছে, সেখানে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে যেসব বিষয় সামনে এসেছিল সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। আবার আমাদের মডেল পিএসসিতে (উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি) কোনো সমস্যা আছে কিনা সেগুলোও যাচাই করবে কমিটি। প্রয়োজনে তারা কনসালটেন্টের (উড ম্যাকেঞ্জি) সঙ্গে কথা বলবে। উড ম্যাকেঞ্জি আমাদের পিএসসি প্রণয়নের পরামর্শক ছিলেন। কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি করা হলেও চলতি বছরের আগে দরপত্র ডাকা হয়নি।
২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ ব্লকে কাজ নেয় কনোকো ফিলিপস। তারা ২টি জরিপ শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি করে। সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়। এ ছাড়া চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি সান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। বাংলাদেশের পাশের ব্লক থেকে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস উত্তোলন করছে মিয়ানমার। যে কারণে বাংলাদেশ অংশে গ্যাস পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের সাগরে গ্যাসের মজুদের বিষয়ে আশাবাদী জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন দেশের গ্যাস সংকট কাটাতে বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারে এ মজুদ।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্য আকর্ষণীয় করে তৈরি করা হয় পিএসসিকে (উৎপাদন বণ্টন চুক্তি)। আগের পিএসসিগুলোতে গ্যাসের দর স্থির করা দেওয়া হলেও এবার ব্রেন্ট ক্রুডের দরের সঙ্গে মিল করে দেওয়া হয়। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান, যা আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫ দশমিক ৬ ডলার ও ৭ দশমিক ২৫ ডলার স্থির দর ছিল।
দামের পাশাপাশি বাংলাদেশের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মডেল পিএসসি-২০১৯ অনুযায়ী গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের অনুপাত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আর কমতে থাকে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার। গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের হিস্যা ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করবে। কিন্তু তারপরও কোনো আগ্রহী প্রতিষ্ঠান না পাওয়াটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের চলমান গ্যাস সংকট ও উৎপাদনরত খনিগুলোর মজুদ কমে আসাটা বেশি করে ভাবাচ্ছে।
মডেল পিএসসি ২০০৮ প্রণয়ন কমিটির প্রধান মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, অনেকে মনে করেছিলেন গ্যাসের দাম বাড়ালেই কোম্পানিগুলো দৌড়ে আসবে। সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেন জমা হয়নি সেটা সত্যিকার অর্থেই বিশ্লেষণ করা দরকার। তিনি বলেন, পিএসসিতে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে, এখানে শর্ত দেওয়া হয়েছে দৈনিক ২০ হাজার ব্যারেল (তেলের সমান) গ্যাস উত্তোলন করে এমন কোম্পানি দরপত্র কিনতে পারবে। এখানেই তো অনেক কোম্পানি বাদ পড়ে গেছে। আমি মনে করি, গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ১০ হাজার এবং অগভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ৫ হাজার ব্যারেল হওয়া উচিত। তাহলে আরও অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিতে পারবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কেউ আগ্রহী হয়নি এমনও হতে পারে বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম