৩ জাতীয় নির্বাচনে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিচার দাবি

এম এইচ রবিন
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
৩ জাতীয় নির্বাচনে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিচার দাবি

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন ছিল অবৈধ, নৈশ ও ডামি ভোটের নির্বাচন। এই তিন জাতীয় নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো চিঠির প্রেক্ষিতে বিএনপির পক্ষ থেকে করা সুপারিশে এ দাবি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৬ বছরে প্রশাসনে চলা দুর্নীতির শে^তপত্র প্রকাশ করা, প্রশাসনের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া এবং অবাধ নিরপেক্ষতার জন্য নির্বাচনের তিন মাস আগে মাঠ প্রশাসনে বদলি পদায়নের সুপারিশও করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।

সচিবালয়ে গতকাল রবিবার জনপ্রশাসন সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের কাছে তার দপ্তরে বিএনপির পক্ষ থেকে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ ‘জনপ্রশাসন এর যুগোপযোগী ও গণতান্ত্রিক সংস্কার’ শিরোনামে জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রস্তাব তুলে দেন। এ সময় বিএনপির করা কমিটির সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসন সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খানও উপস্থিত ছিলেন।

বিগত তিন জাতীয় নির্বাচনে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া; ১৬ বছরে প্রশাসনের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা; অবাধ নিরপেক্ষতার জন্য নির্বাচনের তিন মাস আগে মাঠ প্রশাসনে বদলি পদায়ন করা; প্রশাসনে সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তরে পাঁচ বছরের বেশি না রাখা; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য মন্ত্রণালয় অধস্তন অফিস নিয়মিত পরিদর্শন করা; দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ভবিষ্যতে দুর্নীতি রোধে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জেলাভিত্তিক মনিটরিং সেল স্থাপন করা; প্রশাসনে দক্ষ ও পেশাদার জনবল তৈরি করা; পদায়ন নীতিমালায় মাঠ প্রশাসনের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করাসহ একগুচ্ছ সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এ ছাড়া বিদেশি ডিগ্রিধারী মেধাবী তরুণ ও বিশেষজ্ঞদের রাষ্ট্র গঠনে সম্পৃক্ত করা; বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পদ্ধতিগত সংস্কার করা; ক্যারিয়ার, পদোন্নতির জন্য এসএসসি পুনর্গঠন, পদোন্নতির মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার; প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, মডিউল যুগোপযোগী করা; ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে থেকেও স্পিকার, মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত একান্ত সচিব নিয়োগ দেওয়া এবং অনুমোদিত পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি নিরুৎসাহিত করার বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বিএনপির সুপারিশমালায়।

জনপ্রশাসন সংস্কারের সুপারিশ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের সময়ে ভোট চুরিতে জড়িত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। প্রশাসনে দলীয় নয়, নিরপেক্ষ লোক চায় বিএনপি। পাশাপাশি বৈষম্যের শিকার সব সরকারি কর্মচারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবিও তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আওয়ামী দোসরদের দ্রুত বিতাড়িত করার কথাও সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জবিউল্লাহ। বলেন, প্রশাসনে আমরা কোনো দলীয় লোক চাই না। তারা হবেন নিরপেক্ষ। রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রশাসনে চলবে না।

রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রশাসন সংস্কারের সুপারিশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়েছিলাম। সেই চিঠির আলোকে বিএনপির পক্ষ থেকে সুপারিশ জমা দেওয়া হয়েছে। এটি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে।

সুপারিশ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জনপ্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তাবৃন্দ সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু গত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকারের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সিভিল প্রশাসন তার স্বকীয়তা হারিয়ে একটি দলীয় প্রশাসনে রূপ নিয়েছে। এদের প্রত্যক্ষ মদদে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বিনা ভোটের, নৈশ ভোটের ও ডামি ভোটের অবৈধ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতন, গুম, খুন, মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তা হরণের সাথে সিভিল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিল। মেধাবী, পেশাদার, দক্ষ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করে পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের সহযোগী দলবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করা হয়েছে। জনগণের প্রতি তাদের কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছিল না। সিভিল সার্ভিস হয়ে পড়েছিল সমাজ ও অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নে রাজনৈতিক সহযোগীদের একটি মেশিনারি। এ রকম একটি সার্ভিস বিগত সাড়ে ১৫ বছর বাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সঙ্গে মিলে দেশকে লুণ্ঠন করে। এই আমলে দেশকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ থেকে ‘চোরতন্ত্রে’ পরিণত করা হয়েছে। এই ‘চোরতন্ত্রে’ আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ, ব্যবসায়িক অলিগার্ক এবং সামরিক বেসামরিক আমলারাও ছিল সহযোগী। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, অ্যাসোসিয়েশনের সকল স্তরের কর্মরত সদস্যগণ জনগণের পাশে থেকে উন্নয়নমুখী জনবান্ধব জনপ্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সদস্যদের কল্যাণ, পদমর্যাদা রক্ষা, নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণসহ যুগোপযোগী জনপ্রশাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে রয়েছে এ অ্যাসোসিয়েশনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও গৌরবান্বিত অতীত। কিন্তু বিগত ১৫ বছরে আমাদের এ গৌরবান্বিত অতীত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা পুনরুদ্ধার করা অতীব জরুরি।

এতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমকে বিতর্কিত করার প্রয়াসে বিগত ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার সরকারের দোসররা এখনও সক্রিয় থেকে গোপনে নানা অপকৌশলে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োজিত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে জনমনে যাতে ভীতির সঞ্চার এবং স্বৈরাচারের কোনো অপশক্তি যাতে মাথাচাড়া না দিয়ে ওঠে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।