যত্রতত্র গাড়ির ওয়ার্কশপ

নেই নিয়ন্ত্রণ-নজরদারি

তাওহীদুল ইসলাম
১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
যত্রতত্র গাড়ির ওয়ার্কশপ

গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ রয়েছে দেশের সর্বত্র। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এ ধরনের মেরামত কারখানা থাকলেও বড়জোর ট্রেড লাইসেন্স থাকে। সাধারণত যানবাহন মেরামতের কারখানাগুলোর মালিকরা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) লাইসেন্স নেন না। অনুমোদন ছাড়া গাড়ি মেরামতের কারখানা করা বেআইনিÑ তাও সবার জানা নেই। এতে যথযথ নিয়ম ও অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠছে বেশির ভাগ ওয়ার্কশপ। ফলে কারখানাগুলোর কর্মীদের কারিগরি জ্ঞান ও সুযোগ সুবিধার অভাবে যানবাহন মেরামত করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হন গাড়ির মালিকরা। দীর্ঘদিন এভাবে চলে আসলেও এসব ওয়ার্কশপের লাইসেন্স প্রদানের শর্ত পরিপালন এবং মাননিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি

নেই। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) ওয়ার্কশপকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর অংশ হিসেবে চেসিস আমদানি করে নিজস্ব কারখানায় গাড়ির তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারি। সে অনুযায়ী কাজও করছে সংস্থাটি। ভারী যানবাহনের চালকের অভাব দেশে। এ কাজে বিআরটিসি আরও ভূমিকা রাখতে পারে। বিআরটিসির মাধ্যমে নিজেরাই গাড়ি তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে করে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থের সাশ্রয় হবে। করপোরেশনের ওয়ার্কশপে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের যানবাহন মেরামতও সম্ভব।

আইনের বালাই নেই ওয়ার্কশপ স্থাপন ও পরিচালনায় : জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা ৬৪ (১) অনুযায়ী বেসরকারি পর্যায়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী ফির মাধমে মোটরযান মেরামতের কারখানা (ওয়ার্কশপ) প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। এ বিধান লঙ্ঘন করলে ধারা ৯৭ অনুযায়ী ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। এরই মধ্যে জারিকৃত সড়ক পরিবহন বিধিমালা, ২০২২ এর বিধি ১৫৬ (২) অনুযায়ী বিআরটিএকে রেজিস্ট্রেশন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বলা হয়েছে।

মোটরযান কারখানার লাইসেন্স প্রদান বিধিমালায় বলা হয়েছেÑ মোটরযান মেরামত কারখানাগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মোটরসাইকেল ও থ্রি হুইলার, হালকা মোটরযান, মধ্যম ও ভারী মোটরযান এবং অন্যান্য যানবাহন মেরামত কারখানা। লাইসেন্স দেওয়ার আগে বিআরটিএ’র একজন উপ-পরিচালক, জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, পুলিশ সুপার বা পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি, শ্রম অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের প্রতিনিধি এবং বিআরটিএ’র একজন সহকারী পরিচালক মিলে সুপারিশ দেবে। সেক্ষেত্রে মেরামতকারী ব্যক্তির কারিগরি জ্ঞান, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, কারখানায় অন্তত পাঁচটি গাড়ি রাখার জায়গা থাকা, টিন সার্টিফিকেট ও হালনাগাদ আয়কর রিটার্ন, স্থানীয় কাউন্সিলর বা চেয়ারম্যানের সুপারিশ এবং আর্থিক স্বচ্ছতার সনদ লাগবে। ঠিকানা পরিবর্তন করলেও ১৫ দিনের মধ্যে জানানোর নিয়ম রয়েছে।

বাস্তবে এসব শর্ত পরিপালনের কোনো বালাই নেই মোটরযান মেরামতের ওয়ার্কশপগুলোয়। ফলে লাইসেন্স ছাড়া যত্রতত্র গড়ে উঠছে ওয়ার্কশপ। এ ধরনের ওয়ার্কশপগুলোতে মেরামতকারীদের কারিগরি জ্ঞানের যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি পর্যাপ্ত গাড়ি রাখার জায়গা ও যন্ত্রপাতির অভাব দেখা যায়। ফলে যানবাহন মেরামত করতে গিয়ে কাক্সিক্ষত সেবা না পাওয়াসহ নানা দুর্ভোগের শিকার হন মালিকরা। এ ছাড়া স্থানাভাবে ওয়ার্কশপগুলোর নির্ধারিত জায়গা ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তায় দিনের পর দিন মেরামতের অপেক্ষায় থাকা গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। এতে জনভোগান্তি বাড়ে।

সক্রিয় হচ্ছে বিআরটিসির কারখানা : বিআরটিসির নিজস্ব কারখানার সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে এবার সক্রিয়া হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে এবার গাড়ির চেসিস আমদানি করে নিজস্ব কারখানায় বাস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিসি। এর ফলে বিপুল অর্থ ও সময় বাঁচবে।

জানা গেছে, নিজস্ব কারিগর দিয়ে ঢাকার তেজগাঁও ও গাজীপুরে বিআরটিসির কারখানায় গাড়ি প্রস্তুত করা হবে। সাধারণত প্রকল্পের মাধ্যমে গাড়ি আমদানি করতে হলে ডিপিপি অনুমোদন, চুক্তি সই ও সরবরাহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ন্যূনতম ৩ বছর লাগে। এখন শুধু চেসিস আমদানি করে বিআরটিসি দেশে বসে গাড়ি তৈরি করবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশ থেকে একটি সাধারণ বাস আমদানি করতে হলে গড়ে খরচ পড়ে ১ কোটি ১২ লাখ ৬০০ টাকা। তবে নিজস্ব ওয়ার্কশপে বাস প্রস্তুত করলে খরচ হবে অনেক কম।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিআরটিসির গাজীপুরের সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা (আইসিডব্লিউএস) এবং কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় (সিডব্লিউএস) বড় ওয়ার্কশপ শেড আছে। সেখানে ইঞ্জিন ওভারহলিং, মেশিনশপ এবং গাড়ির বডি তৈরির কাজ করা সম্ভব। করপোরেশনের ওয়ার্কশপগুলোয় ডেন্টিং, পেইন্টিংসহ ওয়ার্কশপ সংশ্লিষ্ট সব কাজের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম আছে। আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও কারিগর।

দক্ষ চালক তৈরির সুযোগ কাজে লাগছে না : বিআরটিসির কারখানায় ড্রাইভিং প্রশিক্ষণেরও সুযোগ আছে। দেশে মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা রয়েছে ৫৯ লাখ ৫২ হাজার ৯২০টি। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় রয়েছে ২০ লাখ ৮১ হাজার ২৬০টি। কিন্তু সে তুলনায় নিবন্ধিত চালক আছেন মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। আবার যারা চালক হিসেবে লাইসেন্স নিয়েছেন, তাদের অনেকের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এর বড় কারণ দেশে দক্ষ চালক তৈরির ব্যবস্থাপনার ঘাটতি। বাস-মিনিবাসের হেল্পার-কন্ডাক্টররা সাধারণত ওস্তাদের (চালক) মাধ্যমে গাড়ি চালনার হাতেখড়ি নেন। ডিউটির সময় চালনা শেখেন সুযোগ বুঝে। এ কারণে গাড়ি চালাতে জানলেও ট্রাফিক আইন এবং নিয়ম-কানুন কমই জানেন তারা। এর জেরে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।

বেসরকারি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যা আছে, তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় কম। আবার এগুলোতে অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনাও কম। তাই সরকারিভাবে প্রশিক্ষণে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু নিজস্ব প্রশিক্ষণ যান, ইনস্ট্রাক্টর, পর্যাপ্ত জায়গা ও সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও এখনও সর্বসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি বিআরটিসি। এর বিপরীতে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়ি দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। নেই প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গা ও অবকাঠামো।

প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে বিপুল জনগোষ্ঠীর। প্রশিক্ষিত হয়ে দেশের বাইরে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। দক্ষ চালক ও কারিগর তৈরির ব্যবস্থা কাক্সিক্ষত ব্যবস্থা রয়েছে বিআরটিসির। সিমুলেটর সংযোজন করে এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে সংস্থাটিতে। মডেল ও প্রকৃত যন্ত্রাংশের সাহায্যে যানবাহনের পরিচিতি ও ব্যবহারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

বিআরটি করিডোরে এসি বাস সার্ভিস : আজ রবিবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) পরিচালনায় শিববাড়ী, গাজীপুর বিআরটি লেনে বিআরটিসি এসি বাসের উদ্বোধন করবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। প্রাথমিকভাবে ১০টি বিআরটিসি এসি বাস গাজীপুরের শিববাড়ী বিআরটি টার্মিনাল থেকে বিআরটি লেনে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ২০.৫ কিলোমিটার এবং এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার মোট ৪২.৫ কিলোমিটার পথ চলাচল করবে। শিববাড়ী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ভাড়া ৭০ টাকা এবং শিববাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া ১৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাসের সংখ্যা পরবর্তীতে বাড়াবে বিআরটিসি।