সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল /
নষ্ট যন্ত্র মেরামতে বাধা, নতুন কেনায় আগ্রহ
ফেলে রাখা যন্ত্র সচল করায় হয়রানির মুখে চার টেকনিশিয়ান ।। নষ্ট দেখিয়ে ২ কোটি টাকার নতুন যন্ত্র ক্রয়
আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) থাকা লাইফ সাপোর্টের রোগীদের সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহার হয় সেন্ট্রাল ভ্যাকুয়াম সাকশন মেশিন। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১৬ সালে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় এই চিকিৎসা যন্ত্র কেনা হয়। ২০২০ সালের দিকে সামান্য ত্রুটি দেখা দিলে সঠিকভাবে মেরামত না করেই এটি ফেলে রাখা হয় তিন বছর। সেই যন্ত্রকে নষ্ট ঘোষণা করে ২ কোটি টাকায় কেনা হয় নতুন যন্ত্র। অভিযোগ উঠেছে, শুধু এই যন্ত্র নয়, জীবনরক্ষাকারী এমন বহু চিকিৎসা যন্ত্রের ত্রুটি দেখা দিলেই মেরামত না করে নতুন করে কেনা হয়েছে, যার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, নষ্ট দেখিয়ে ফেলে রাখা যন্ত্র মেরামত করায় চার টেকনেশিয়ানকে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এই অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালটির উপসহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুদ জামানের বিরুদ্ধে। আর তার এই অনিয়মের সঙ্গে ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) একটি সিন্ডিকেট জড়িত বলে জানা গেছে।
এরই মধ্যে হাসপাতালের শীর্ষ কর্তারা বিষয়টি ধরতে পেরে এই প্রকৌশলীকে ছাড়াই যন্ত্র মেরামত ও প্রয়োজনীয় যন্ত্র কেনাকাটার কাজ করছেন বলে জানা গেছে। হাসপাতালটির বায়োমেডিক্যাল টেকনিশিয়ানরা জানান, ভালো যন্ত্রকে নষ্ট দেখিয়ে ফেলে রেখে কোটি কোটি টাকা দিয়ে নতুন যন্ত্র কেনা হয়েছে। শুধু এই যন্ত্র নয়, অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড ভেন্টিলেটর মেশিন ও পোর্টেবল এক্স-রে’সহ ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার যন্ত্র সচল করেছেন তারা।
টেকনিশিয়ানরা বলেন, যন্ত্রপাতি সচল করায় তাদের প্রতি হাসপাতাল পরিচালকের সরাসরি নির্দেশনা রয়েছে। ফলে অনেক ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতিও সচল করা সম্ভব হচ্ছে। তবে এই কাজটি উপসহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুদ জামান মেনে নিতে পারছেন না বলে তারা অভিযোগ করেন। এমন কী, এ কারণে তার রোষানলে তাদের পড়তে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে সেন্ট্রাল ভ্যাকুয়াম সাকশন মেশিনের অভাবে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীদের ব্যাপকভাবে সংক্রমণ হতো। ফলে রোগীরা সঠিকভাবে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট পেতেন না। এতে করে রোগীদের ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় পোর্টেবল সাকশন মেশিন কিনে দেওয়া লাগত, যেটা মূলত বাসাবাড়িতে ব্যবহার হয়। সমস্যা সমাধানে ৫০ লাখ টাকায় যন্ত্রটি কেনা হয়। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সামান্য ত্রুটি দেখা দিলে সঠিকভাবে মেরামত না করেই নষ্ট বলে ফেলে রাখা হয়। পরে ১ কোটি ৭৭ লাখ ২০ হাজার টাকায় নতুন করে দুটি যন্ত্র কেনা হয়। এরই মধ্যে নতুন যোগদান করে তিন বছর পড়ে থাকা সেই যন্ত্র সচল করেন চার টেকনিশিয়ান, যা আট মাস ধরে সেবা দিচ্ছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
একইভাবে নষ্ট বলে ফেলা রাখা ৩ কোটি টাকা মূল্যের ছয়টি অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড ভেন্টিলেটর মেশিন, ২ কোটি টাকা মূল্যের চারটি কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র (লাইফ সাপোর্ট ভেন্টিলেটর), ৪ কোটি টাকা মূল্যের ছয়টি পোর্টেবল এক্স-রে, দুটি ডায়ালাইসিস যন্ত্র, ২০টি পেশেন্টে মনিটর, ছয়টি ওটি লাইট, ছয়টি অপারেটিং টেবিল, দুটি ল্যাপারেস্কপি মেশিন ও ছয়টি ইসিজি যন্ত্র মেরামত করেছেন এই টেকনিশিয়ানরা।
মেডিক্যাল টেকনিশয়ান (বায়োমেডিক্যাল) সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালে অনেক যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট বলে ফেলে রাখা হয়েছে। আসলে সেগুলো নষ্ট ছিল না। সঠিকভাবে মেরামত করা গেলে সচল করা সম্ভব, যা আমরা করছি। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে বাধারমুখে পড়তে হচ্ছে। দুর্নীতি বন্ধ হওয়ায় এখান থেকে আমাদের তাড়ানোর চেষ্টা করছে একটি মহল।’
একই অভিযোগ করেছেন আরও তিন টেকনিশিয়ান। বিষয়টি নিয়ে গত ১৯ নভেম্বর হাসপাতাল পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন চার টেকনিশিয়ান। সাজেদুল ইসলাম ছাড়াও বাকি তিন টেকনিশিয়ান হলেন হৃদয় চন্দ্র মল্লিক, এখলাস উদ্দিন ও মো. খলিলুর রহমান।
লিখিত অভিযোগে টেকনেশিয়ানরা বলেন, বায়োমেডিক্যাল যন্ত্রপাতিগুলো সচল করায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে হাসপাতালের আইসিইউসহ সব সেবায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। তারা বলেন, তারা যোগদান করার পর থেকে গত প্রায় ১৫ মাসে হাসপাতালে পড়ে থাকা ৮-১০ কোটি টাকা মূল্যের অচল ও নষ্ট যন্ত্রপাতি মেরামত ও সচল করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের প্রতিটি যন্ত্রপাতি মেরামতের সার্ভিস রিপোর্ট প্রমাণসহ সংরক্ষিত রয়েছে। তবে হাসপাতালের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর (মোহাম্মদ তৌহিদুদ জামান) মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি, হুমকির স্বীকার হয়ে আসছেন তারা। ফলে কাজে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন এবং বদলি আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
তবে এই অভিযোগের দায় এড়িয়ে যান উপসহকারী প্রকৌশলী (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার) তৌহিদুদ জামান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘দায়িত্বে আমি থাকলেও ওই যন্ত্র কেনাকাটায় আমার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিমিউয়ের মাধ্যমে কিনেছে। আর এসব যন্ত্র আমরা ঠিক করতে পারি না। নিমিউতে চিঠি দিতে হয়, সেখান থেকে কেনা হয়।’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোন যন্ত্র মেরামত করতে হবেস সেটি আমার মাধ্যমে হওয়ার কথা। টেকনিশিয়ানরাও আমার অধীনে থাকবে। কিন্তু হাসপাতাল পরিচালক আমাকে উপেক্ষা করেই সরাসরি তাদের নিয়ে কাজ করছেন। তাহলে আমি এখানে কেন? আমাকে কাজে লাগাতে মন চাইলে লাগাবে, না করলে নেই। আমার অন্য কোনো কাজ নেই।’
টেকনিশিয়ানদের হয়রানির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তৌহিদুদ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করে থাকলে কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে যে ব্যবস্থা নেবে, আমি মেনে নেব। তবে এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘গত দুই অর্থবছরে হাসপাতালে কোনো ভারি যন্ত্রপাতি কেনা হয়নি। যেটির কথা বলছেন, সেটি আমার আমলে নয়।’ তিনি বলেন, ‘কেউ কাউকে হয়রানি করলে দেখা হবে। তবে এখনও এই ধরনের অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো আমাদের সময়কে বলেন, ‘সত্যিই যদি এমন হয়ে থাকে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি। একজন চিকিৎসক মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির ত্রুটি ধরতে পারেন না। এটি বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ। সেটি যদি তিনি করতে না পারেন এবং সরকারি অর্থ অপচয় হয়, তাহলে তার সেখানে থাকার দরকার নেই। একই সঙ্গে যারা কাজ করছেন, তাদেরকে হয়রানি করাও অপরাধ। বিষয়টি নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন